ক্রেতাদের পন্যের চাহিদা মেটাতে পারছে না কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীর ব্যবসায়ীরা

*) ধারনার চেয়ে কয়েকগুন বেশি বেচা কেনা হয়েছে বিক্রেতারা

*) পূজির অভাবে পর্যাপ্ত মাল করতে পারে নি

*) চায়না থেকে মাল কম আশায় দেশীয় পোষাক বিক্রি বেশি

মাত্র তিনমাস আগেও চলতি ঈদ মৌসুম নিয়ে ভীষন চিন্তিত ছিলো কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীর ব্যবসায়ীরা। করোনার ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট ছিলো তাদের চিন্তার মূল কারন। ওমিক্রনের কারনে দেশে লক ডাউনের একটা সঙ্কা দেখা গিয়েছিলো। দুই মৌসুম বন্ধ থাকার পরে অনেক ব্যবসায়ী ঝুকি নিয়ে চলতি মৌসুমে পন্য উৎপাদন শুরু করেছিলো। অনেকেই ভেবেছিলো গত দুই মৌসুমের মতো এবারো হয়তো ঈদ মৌসুমে তারা ব্যবসা করতে পারবে না। যার ফলে উৎপাদিত পন্য নিয়ে অনেক ব্যবসায়ীর মধ্যে তখন হতাশা পরিলক্ষিত হয়। তবে তিনমাস যেতে না যেতেই তাদের সে হতাশা এখন আশায় পরিবর্তিত হয়েছে। পাল্টে গেছে কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীর প্রেক্ষাপট। এখনকার চিত্রটা সর্ম্পূর্নই উল্টো। সারা দেশ থেকে প্রচুর ক্রেতা পাইকারী পোষাক কেনার জন্য ভীড় করছে কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীতে। তবে পোষাকের প্রচুর চাহিদা থাকলেও স্টকের অধিকাংশ মাল শেষ হয়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের চাহিদা পূরন করতে পারছে না গার্মেন্টস পল্লীর ব্যবসায়ীরা।

কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীতে শোরুম রয়েছে প্রায় ১০ হাজার। কারখানার সংখ্যা ছয় হাজারের মতো। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় ৮ লাখ শ্রমিক। সারা দেশের ক্রেতারা পোশাক কিনে নিয়ে যায় এখান থেকে। ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের তৈরি পোশাকের ৬০ শতাংশ চাহিদা মেটায় কেরানীগঞ্জের এই গার্মেন্টস পল্লী। এখানকার ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ী নিজেরা পোশাক উৎপাদন ও বিক্রি করেন। বাকি ৩০ শতাংশ চীন, ভারত, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পোশাক এনে বিক্রি করেন।

সরেজমিন কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটা দোকানে পাইকারদের প্রচুর আনোগোনা রয়েছে। ব্যবসায়ীরা তাদের পন্য বিক্রি করার জন্য ব্যস্ত সময় পার করছেন। একটু দম ফেলার ফুরসত নেই যেন তাদের। যে যার মতো পন্য বিক্রি করতে ব্যস্ত।  অধিকাংশ ব্যবসায়ীর চোখে মুখে খুশির একটা ছোপ । দীর্ঘ সময় পরে কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীর ব্যবসায়ীরা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলতে পাড়ছেন। তবে গার্মেন্টস পল্লীর ব্যবসায়ীরা বেচা বিক্রি নিয়ে সন্তুষ্ট হলেও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত ক্রেতারা নাখোশ। অধিকাংশ ক্রেতাই অভিযোগ করছে তারা তাদের চাহিদা অণুযায়ী পন্য নিতে পারছে না , রোজা শুরু হতেই পাইকারী পন্যের সংকট। সারা মৌসুমে তারা কি বিক্রি করবেন এ ভাবনায় তাদের চোখে মুখে চিন্তার ছোপ।

সাতক্ষীরা থেকে কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীতে পন্য কিনতে  এসেছেন মো: বাহার নামে এক ব্যবসায়ী। তার সাথে কথা হলে দেশ রূপান্তরক বাহার জানান, প্রতি বছর ঈদের জন্য পন্য কিনতে তিনি দুইবার আসেন কেরানীগঞ্জের গার্মেন্টস পল্লীতে। শবে বরাতের কয়েকদিন আগে অর্ধেক পন্য কিনে নেয়ে যান। আরেকবার আসেন রোজার ২/১ দিন আগে। এবার শবে বরাতের আগে এসে তিনি সাড়ে ৬ লাখ টাকার তৈরী পোষাক তার দোকানের জন্য। আজকে এসেছেন দ্বিতীয় দফা পোষাক কিনতে। কিন্তু তার চাহিদা অনুযায়ী ছয় লাখ তো দূরে, আজকে তিন লাখ টাকার পন্যও কিনতে পারেন নি তিনি। তার চাহিদা অনুযায়ী বাকি পন্য মেলাতে পারবেন কি না এ নিয়ে তিনি সংকায় রয়েছেন।

মাদারীপুরের পুরান বাজার থেকে কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীতে পোষাক সংগ্রহ করতে এসেছেন সাইফুর রহমান। একই সুরে তিনি জানান, ঈদ মৌসুমকে সামনে রেখে এখোনো তার সোরুমের জন্য সম্পূর্ন মাল কালেকসশন করতে পারেন নি তিনি। ধারনা করতে পারেন নি, রোযার শুরুতেই কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীতে পন্যের সংকট দেখা দিবে। তাছাড়া পন্যের চাহিদা বেশি ও যোগান কম থাকায় এখানকার ব্যবসায়ীরা প্রতিটা পন্যে দুই তিনশ টাকা বেশি মুনাফা করছেন বলে এই ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন।

কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীর খাজা সুপার মার্কেটের জারান পাঞ্জাবী হাউজের ইনচার্জ জোবায়ের রহমান  জানান, আমাদের সিজন শুরু হয় মোটামুটি শবে বরাত থেকে, থাকে ২০/২২ রোজা পর্যন্ত। তবে এ বছর শবে বরাতের মাস খানেক আগে থেকেই আমাদের সিজন শুরু হয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাষ্টমাররা শবে বরাতের মাস থানেক আগে থেকেই আমাদের কাছ থেকে মাল কিনতে শুরু করেছিলো। আমরা যা আশা করেছিলাম আলহামদুলিল্লাহ তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি বিক্রি করেছি। স্টকে পন্য না থাকায় আমরা এখন কাষ্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী পন্য দিতে পারছি না। এছাড়া কাচামালের ঘাটতি থাকায় এখন পর্যাপ্ত প্রোডাকশন করা যাচ্ছে না। আগে আমরা কাচামাল বাকিতে কিনতে পারতাম গত ২ বছর করোনার ধাক্কায় কাচামাল এখন বাকিতে বিক্রি করে না, নগদ টাকায় কিনতে হয়েছে। এই কারনে প্রোডাকশন কম, যার কারনে পন্যের ঘাটতি রয়েছে। আমাদের একটা সোরুমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ২৫০ জন বায়ার আসে পাইকারী পাঞ্চাবী ক্রয় করতে, এই পর্যন্ত মাত্র ২০% বায়ার এসেছে, তাতেই আমাদের প্রোডাক্ট স্টক আউট হয়ে গেসে। এখন বাকি বায়ারদের কিভাবে পন্য দিবো এটা নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি।  এখন এক একজন কাষ্টমার আসছে যারা জারান পাঞ্জাবী থেকে ১ লাখ টাকার পাঞ্জাবী কিনবে , তাদের আমরা ২০-৩০ হাজার টাকার বেশি পাঞ্জাবী দিতে পারছি না। পন্যর প্রচুর চাহিদা থাকলেও আমরা দিতে পারছি না।

মের্সাস মমতা এন্টার প্রাইজের সত্তাধিকারী জামাল উদ্দিন মাহমুদ জানান, বেচা বিক্রি খুব ভালো, আমরা পন্য আমদানির জন্য এখন চায়না যেতে পারি না, তাই আমাদের পছন্দসই পন্য আমদানি করতে পারি না। তবে এ বছর বিদেশ থেকে যা পন্য আমদানি করেছি তার সবই বেক্রি হয়ে গেছে। বেচাকেনা এভাবে চলতে থাকলে করোনায় আমাদের যে লস হয়েছে সেটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো, আমরা আমাদের হারানো পুজি ইন সা আল্লাহ আবার ফেরত পাবো।

নবরাজ পেন্ট হাউজের সত্তাধিকারী ও পোশাক আমদানি কারক জাহাঙ্গীর হাসান জানান, এখন আমরা চায়ণা থেকে কন্টিনারে মাল আনতে পারি না, এয়ারে করে মাল আনতে হয়। আমাদের যে পরিমান মাল দরকার সে অনুযায়ী মাল আমরা আনতে পারি না। বেচা কেনা এ বছর যথেষ্ট ভালো। মাল আশা মাত্রই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তবে সঠিক সময়ে আমরা মাল পাচ্ছি না। রাস্তায় আমাদের অনেক মাল ওয়েটিং এ আছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আসলে তার সব ই বিক্রি হয়ে যাবে আশা করি। চায়না থেকে মাল কম আশায় এবার দেশীয় ব্যবসা যথেষ্ট ভালো হয়েছে। আমাদের এখানে প্রচুর কাস্টমার রয়েছে এখন। ক্রেতারা আমাদের কাছ থেকে মাল না পেয়ে দেশীয় তৈরী পোশাক সংগ্রহ করছে। সব মিলিয়ে আলহামদুলিল্লাহ এ বছর কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীর ব্যবসা যথেষ্ট ভালো।

কেরানীগঞ্জ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পন্য ডেলেভারী দেয়া হয় সাধারনত কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর মাধ্যমে। পন্য পরিবহনকারী একটি কোম্পানী রেইনবো এক্সপ্রেস পার্সেলের ম্যানেজার রাকিবুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি জানান, এ বছর আমাদের টার্গেটেরে চেয়ে তিনগুন বেশি পন্য পরিবহন করছি আমরা। ভেবেছিলাম গত বারের চেয়ে হয়তো এবার চাপ একটু বাড়বে। তবে এতটা বাড়বে এটা ভাবি নি। প্রতিবছর শবে বরাতের পর থেকে মালের চাপ বেশি থাকে, তবে এবার শবে বরাতের অনেক আগে থেকেই মালের চাপ বেড়েছে। প্রতিদিন ই আমাদের মাধ্যমে কেরানীগঞ্জ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর মাল যাচ্ছে। শুধু আমাদের কুরিয়ার না, আশে পাশের সকল কুরিয়ার গুলোতেই মালের অনেক চাপ রয়েছে।

কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক মুসলিম ঢালী বলেন, এ বছর কেরানীগঞ্জের গার্মেন্টস পল্লীর ব্যবসা বানিজ্য ভালো, তবে মালের যথেষ্ট সংকট রয়েছে। এর কারন হচ্ছে টাকার সংকট। টাকার সংকটের কারনে পন্যের যথেষ্ট সংকট রয়েছে। কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীতে প্রায় ৩০ টি ব্যাংকের শাখা রয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র কয়েকটা ছাড়া বাকি সব গুলো ব্যাংক ই নামমাত্র তাদের শাখা খুলে রেখেছে। এরা ব্যবসায়ীদের কোন লোন দিতে চায় না, কোন সাপোর্ট দেয় না। ছোট ব্যবসায়ী যারা আছে, যারা লোন করে ব্যবসা করে, তাদেরকে ব্যাংক এ বছর কোন লোন ই দেয় নি। পূজি সংগ্রহ করতে না পেরে অনেক ছোট ব্যবসায়ী এ বছর তাদের কারখানাই চালাতে পারে নি, যার কারনে পন্য কম উৎপাদিত হয়েছে । ব্যাংকের সাপোর্ট পেলে এবার আমারা ব্যবসা ভালো করতে পারতাম। ব্যাংক গুলো ছোট ব্যবসায়ীদের করোনার আগে ৫লাখ/১০ লাখ আনসিকিউরিটি লোন দিতো। করোনার পরে ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেছে যে তোমরা আগের লোন পরিশোধ করো তাহলে পুনরায় লোন দেয়া হবে। ব্যবসায়ীরা এনি হাউ আগের লোন পরিশোধ করলেও ব্যাংকগুলো তাদের কথা রাখে নি, পুনরায় আর লোন দেয় নি। এ কারনে ছোট কারখানা মালিকরা পূজি গুছাতে পারে নি, কারখানাও চালাতে পারে নি। এছাড়া আমাদের এখানকার ব্যবসায়ীরা প্রনোদনাও ঠিক মতো পায় নি। ব্যাংকগুলো আমাদের নামমাত্র প্রনোদনা দিয়েছে। কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লী আমাদের দেশের একটা গর্ব এবং তৈরী পোশাকের একটা নির্ভরযোগ্য স্থান। দেশীয় পোশাক খাতে ভর্তুকি দেওয়া উচিত, ব্যবসায়ীদের সুযোগ সুবিধা দেয়া উচিত। কারন দেশীয় পোশাক খাতটা ধ্বংশ হয়ে গেলে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে বিরাট একটা ঘাটতি দেখা দিবে।

 

কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির সভাপতি স্বাধীন শেখ বলেন, ব্যবসায়ীরা এবছর যে টার্গেট করেছে তা লক্ষ্য মাত্রা অর্জিত হয়েছে। এভাবে চললে আমরা করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারবো। বেচা কেনা ভালো হওয়ায় রমজান মাস শুরুর আগেই পন্য সব শেষ হয়ে গেছে তাই পন্য সংকট দেখা দিয়েছে। #

Check Also

কেরানীগঞ্জে-দখলকৃত-বাড়ি-ফিরে-পেল-ভুক্তভোগী-পরিবার

কেরানীগঞ্জে আব্বা বাহিনীর বাড়ি দখল,১০মাস পর বাড়িতে ঢুকলো দম্পতি

ঢাকার কেরানীগঞ্জে আলোচিত আব্বা বাহিনীর হাতে দখল হওয়ার ১০ মাস পরে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের …