হাসানের একদিন : জান্নাতুল ফেরদৌস পুষ্প

প্রতি ভোরে সূর্য উঠে নতুন একটি দিনের আগমনী বার্তা হয়ে। ভোরের সেই সূর্য দেখার সৌভাগ্য বর্তমানে খুব কম মানুষেরই হয়। কিন্তু হাসান গত দু’বছরের প্রতিটা সূর্য উঠতে দেখেছে একা বারান্দায় বসে। আজ হাসানের বেশিক্ষণ বারান্দায় বসা হবে না, অনেক কাজ বাকি রয়েছে।

ক্যালেন্ডারের পাতায় এক পলক তাকিয়েই ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সেড়ে বেড়িয়ে পরে সে। হাসানের বাসা থেকে আধা কিলোমিটার দূরের রেললাইনে যেতে হবে তাকে। মন খারাপ থাকলে হাসান মাঝে মাঝে সেখানে একা একা বসে থাকে। সবচেয়ে কষ্টে থাকা মানুষগুলোই মনে হয় রেললাইনের আশেপাশে বাস করে। হাসান হেটে হেটে তাদের কষ্টগুলো দেখে।
মানুষের কষ্ট দেখলে নাকি নিজের কষ্টগুলোকে ভুলে থাকা যায়। রেললাইনের পাশে বেড়ে উঠা কিছু পথশিশুর প্রিয়মুখ হয়ে উঠেছে হাসান। গত দুইবছর নিজের কোন বন্ধুর সাথেই যোগাযোগ রাখেনি সে, তাই এইসব বাচ্চাদের তার খুব বেশি আপন মনে হয়। কিন্তু হাসান একসময় এমন ছিল না।
বড়লোক বাবার দুই সন্তানের মধ্যে হাসান সবার ছোট। মা-বাবা আর একমাত্র বোনের খুব আদরের সে। দুরন্ত হাসান পড়ালেখায়ও ভাল ছিল। কিন্তু হঠাৎই তার এই পরিবর্তন কেউই মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু তারা কখনও হাসানকে এ নিয়ে কিছু বলেনি। হাসান তাদের লাল আর অভিমানমাখা চোখগুলো দেখে সব বুঝতে পারে, তবুও না বোঝার অভিনয় করে যাচ্ছে নিরন্তর।
আজকে বেশিক্ষণ রেললাইনের পাশে থাকা যাবে না, আজ তো অনেক কাজ। হাসান বাচ্চাগুলোকে চকলেট কিনে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো। হাসান হাটতে পছন্দ করে। এদিক সেদিক সে হেটে বেড়ায়। হেটে হেটে মানুষ দেখে, মানুষের ব্যস্ততা দেখে। ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের কতই না ভাবনা। প্রেমিক পার্কের বেঞ্চে বসে প্রেমিকাকে দেখাচ্ছে ভবিষ্যতের সুন্দর কিছু স্বপ্ন, কেউ কাঁধে স্কুল ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে সুন্দর একটা ভবিষ্যতের জন্য। রিক্সাচালকটারও একটা ভবিষ্যৎ স্বপ্ন আছে, তার মেয়েটার একটা ভাল বিয়ে হবে কিংবা ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে।
একদিন হাসান তার কাজের মাসিকে জিজ্ঞেস করেছিল তার স্বপ্ন কি? কাজের মাসি বলেছিল, মামা স্বপ্ন তো প্রত্যেকদিনই পাল্টায়, একটা কইরা স্বপ্ন ভাঙ্গে আর নতুন আরেকটা কইরা স্বপ্ন দেখি আমরা।
ভবিষ্যতের এই স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোর জন্য হাসানের মায়া হয়, মানুষ স্বপ্ন পূরণে কতকিছুই না করে, কিন্তু দিনশেষ বেশিরভাগকেই ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে বাসায় ফিরতে হয়। হাসানের কোন স্বপ্ন নেই, যার কোন ভবিষ্যৎই নেই, তারা আবার স্বপ্ন! আজ কিছু প্রিয় মানুষের সাথে দেখা করতে হবে। প্রথমেই সে গেলো রহিম পাগলের কাছে, এই পাগলের সাথেই গত দুইবছর সে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছে। তার ধারণা এই পাগলই তাকে সবচেয়ে বেশি ভাল বোঝে।
আব্বাস চাচা হাসানের আরেকজন কাছের মানুষ, ছোটবেলা থেকেই হাসানকে দেখেশুনে রেখেছিলেন তিনি। হাসানকে দেখে চোখের কোণে আসা জল মুছতে লাগলেন আব্বাস চাচা, মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই, এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না, তাই হাসান আব্বাস চাচাকে সালাম দিয়েই চলে আসলো। আরও অনেকের সাথেই দেখা করার ইচ্ছা থাকলেও আব্বাস চাচার অবস্থা দেখে আর যেতে ইচ্ছে করলো না তার। শরীরটাও দূর্বল লাগছে তাই বাসার দিকে রওনা হলো সে।
বাসায় এসে দেখে অনেক মানুষ। বেশি মানুষ হাসানের বিরক্ত লাগে। তাই কারও সাথে কথা না বলে সে নিজের রুমে চলে আসলো। হাসান, কেমন আছো? দুই বছর পর মায়ার কন্ঠ শুনে কিছুটা চমকে গেলো হাসান। মায়া, তার এক দুঃসম্পর্কের খালার মেয়ে। দু’জনই একে অপরকে পছন্দ করতো, কিন্তু কেউই মুখ ফুটে কখনও কিছু বলে নি। ‘ভাল আছি’ বলেই হাসান মুচকি হাসলো। তাদের মধ্যে আর কোন কথা হয়নি। অনেকসময় কথা বলার চেয়ে নিরবতাই মনে হয় বেশি অর্থবহ হয়।
তিন বছর আগে হাসানের ক্যান্সার ধরা পরে। কবে যে ক্যান্সার তার শরীরে বাসা বেধেছিল সেটা কেউই বুঝতে পারে নি, যখন পেরেছিল তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। শেষ ধাপ, বছর খানেক অনেক চিকিৎসার পর ডাক্তার বলেছিল হয়তো আর দুই বছর বাঁচবে। আজ সেই দুইবছরের শেষদিন, তাই হাসান পৃথিবীটাকে শেষবারের মত দেখে নিলো। পৃথিবী সুন্দর, অসহ্য রকমের সুন্দর। এত সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে কেউই যেতে চায় না, হাসানকে যেতে হবে তার ডাক এসে গেছে। এরপর মাসখানেক হাসান বেঁচে থাকলেও সে আর ঘরের বাইরে যায়নি। মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করতে করতেই কোন এক ভোরে সূর্য না দেখেই সে চলে গিয়েছিল সবাইকে ছেড়ে।

 

লেখক: জান্নাতুল ফেরদৌস পুষ্প

Check Also

ড. ইউনূস

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়বেন না ড. ইউনূস

বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাঁড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা …