জিনজিরা প্রাসাদ

দখলে দখলে অস্তিত্ব সংকটে জিনজিরা প্রাসাদ

পলাশীর যুদ্ধের পরে নবাব সিরাজ উদ দৌলার স্ত্রী, কন্যা, মা ও কুচক্রী খালা ঘষেটি বেগমকে যে প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো কালের বিবর্তনে দখলদারদের দৌরাত্বে সেই প্রাসাদটিই যেন আজ বন্দী হয়ে আছে। দখল হতে হতে নিশ্চিহ্ন হতে বসলেও জিনজিরা প্রাসাদ এর করুন অবস্থা দেখার যেন কেউ নেই।

জিনজিরা প্রাসাদ এর ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, ১৬২০ থেকে ১৬২১ মতান্তরে ১৬৮৯-১৬৯৭ খৃষ্টাব্দে তৎকালীন মুঘল সুবেদার নওয়াব ইব্রাহিম খা জিনজিরা প্রাসাদটি নির্মান করে ছিলেন। প্রাসাদটি নির্মান করা হয়েছিলো প্রমদকেন্দ্র হিসেবে। ১৭০২ সালে মুর্শিদ কুলি খা বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নিলে পরিত্যক্ত হতে শুরু করে জিনজিরা প্রাসাদ।

বাংলার ইতিহাসের বহু হৃদয় বিদারক ও বিয়োগান্ত ঘটনার সাক্ষী এই প্রসাদটি। নবাব সরফরাজ খানের পতনের পর তার মা, স্ত্রী, বোন, পুত্রকন্যা এবং তার হেরেমেরে কয়েকজন নারীকে এই প্রাসাদে বন্দী রাখা হয়। ১৭৫৪ সালে হোসেন কুলি খানের হত্যাকান্ডের পর এই প্রাসাদে বসবাসরত তার পরিবারের সদস্যদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল এখানে।

পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর নবাব সিরাদ্দৌলার মা আমেনা বেগম, স্ত্রী লুতফুন্নেসা বেগম, মেয়ে জোহরা ও আলীবর্দী খানের স্ত্রী শরিফুন্নেসা এই প্রাসাদে বন্দী রাখা হয়। তাদের সাথে বন্দী রাখা হয় পলাশীর যুদ্ধের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী কুচক্রী ঘসেটি বেগমকেও।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পতনের পর হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান তৈরি হলে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ করা হয়। এ সময় পুরান ঢাকার ইসলামপুরে নবাববাড়ি ও লালবাগ কেল্লা সংরক্ষণ করা হলেও ঐতিহ্যবাহী জিনজিরা প্রাসাদ টি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিগত ৫০ বছরে নবাবদের এ প্রাসাদের জমি দখল করে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতারা বহুতল ভবন তৈরি করেছে।

সরেজমিন কেরানীগঞ্জের জিনজিরা ইউনিয়নে জিনজিরা প্রাসাদে গিয়ে দেখা যায়, অযত্নে অবহেলা আর দখলদারদের দৌড়াত্বে প্রাসাদের সব কিছুই ধ্বংশ হয়ে গেছে। এক সময়ে যে প্রাসাদে বন্দী থাকতো মানুষ, কালের বিবর্তনে চারপাশ থেকে মানুষই সেই প্রাসাদকে বন্দী করে ফেলেছে এখন। প্রাসাদের চারপাশ থেকে দখল করতে করতে নাম মাত্র একটি অংশ কোনমতে জীর্নসীর্ন অবস্থায় টিকে আছে। ঘরের চারপাশে আগাছা ও লতাপাতার ছড়াছড়ি।

দখলের তান্ডবের মাঝেও এখোনো টিকে আছে প্রাসাদের মূল প্রবেশ দ্বার। বাহির থেকে কেউ প্রাসাদ দেখতে আসতে চাইলে স্থানীয় দখলদারদের হুমকি ও হামলার শিকার হতে হয়। প্রাসাদের অবশিষ্ট কয়েকটি দেয়ালে সংস্কৃত বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের একটি সাইন বোর্ড ঝুলানো আছে দায়সারা ভাবে। সাইনবোর্ডটিতে লেখা রয়েছে ২০১৫ সালে ২১ ডিসেম্বর জিনজিরা প্রাসাদ সংরক্ষনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়। দীর্ঘ ৬ বছর পার হয়ে গেলেও কোন কার্যক্রম ই গ্রহন করা হয় নি এখন পর্যন্ত। যে আগ্রাসী রূপে দখল চলছে এভাবে চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যেই এই সামান্য অংশটুকুও হয়তো মুছে যাবে।

স্থানীয় কয়েকজন এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে যানা যায়, যারা জিনজিরা প্রাসাদের জায়গা দখল করে রেখেছে তারা অনেক প্রভাবশালী, অনেকেই আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জড়িত। প্রাসাদে কেউ ঢুকতে চাইলে তাকে হামলা ও হয়রানির স্বীকার হতে হয়। এমনকি বেশ কয়েকবার খবর সংগ্রহ করতে আশা সাংবাদিকদের ওপর ও হামলা হয়েছে। ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের ক্যামেরা। সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুতই কোন উদ্দ্যোগ নেয়া না হলে বাকি অংশটুকু হারিয়ে যাবে বলেন আক্ষেপ করেন তারা।

দেএশিয়ার স্থপতিদের সংগঠন আর্ক এশিয়ার সভাপতি ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান আবু সাঈদ এম আহমেদের সাথে কথা হলে নিউজ ঢাকাকে তিনি বলেন, জিনজিরা প্রাসাদ মুঘল আমলের অন্যতম একটি নিদর্শন। এমন নির্দশন খুব কম ই আছে। কিন্তু দিন দিন দখলদারদের দৌরাত্বে এটি হারিয়ে যাচ্ছে। অতি স্বত্তর উদ্ধারের উদ্দ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। ডিসি অফিস দখলের বিষয়টা দেখলে আস্তে আস্তে উদ্ধার করতে পারবে। সরকারের উচিত কঠোর ভাবে অবৈধ দখল হয়ে যাওয়াগুলো উদ্ধার করা। সেই সাথে প্রাসাদটিকে সংরক্ষনের ব্যবস্থা করা।

জিনজিরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী সাকুর হোসেন সাকু জানান, জিনজিরা প্রাসাদের কিছু পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে কিছু মানুষ দখল করেছে। দখল উচ্ছেদে একটা পরিকল্পনা ছিলো, তবে এলাকার মানুষের চাপের মুখে ঐটা স্থগিত আছে এখন।
এ বিষয়ে ঢাকা-৩ আসনের সাংসদ বিদ্যুৎ জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, জিনজিরা প্রাসাদ সংরক্ষনে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয় সেই লক্ষ্যে ৪ বছর আগেই একটি পরিকল্পনা সংস্কৃত মন্ত্রনালয়ে ও স্থানীয় ইউএনও অফিসে দেয়া হয়েছিলো। তারা একটি সাইনবোর্ড ও লাগিয়ে গেছে ঐ খানে। এ নিয়ে কাজ চলছে ওরা ভালো বলতে পারবে।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেহেদী হাসান বলেন, অতিশীঘ্রই সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগীতা নিয়ে জিনজিরা প্রাসাদের দখলদার উচ্ছেদে দ্রæত ব্যবস্থা নেয়া হবে। জিনজিরা প্রাসাদের দখলদারদের উচ্ছেদে আমরা সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকবো। #

 

নিউজ ঢাকা ২৪।

আরো পড়ুন: অভয়ারন্যের……..

Check Also

বুড়িগঙ্গা নদী তে লঞ্চ ডুবে ৩৪ জনের মৃত্যু: ৪ বছরেও শেষ হয়নি বিচার

বুড়িগঙ্গা নদী তে লঞ্চ ডুবে ৩৪ জনের মৃত্যু: ৪ বছরেও শেষ হয়নি বিচার

২০২০ সালে ২৯ জুন সদরঘাটের শ্যামবাজার এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদী তে অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে লঞ্চ ‘মর্নিং …