বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রাত্রি- যা পুরো জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। সময়ের স্রোতে আজ সেই ঘটনার পর তিনটি বছর পেরোতে চলল। সেই রাতে, ঢাকা শহরের একটি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁয় একদল পথভ্রষ্ট তরুণ নির্মমভাবে হত্যা করে ২২ জন দেশী ও বিদেশী নাগরিককে।
সেই অসহায় প্রাণ হারানো মানুষগুলোর মাঝে আমরা হারিয়ে ফেলি আমাদের প্রিয় অবিন্তাকে, যে ছিল একজন নিষ্ঠাবান ও নিজ দেশের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। তার স্বপ্ন ছিলো উচ্চ শিক্ষা শেষে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অগ্রসর হওয়ার। সুদূর আমেরিকায় ‘অক্সফোর্ড কলেজ অফ এমোরি ইউনিভার্সিটি’তে স্বার্থকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বছর শেষ করে সেই সময় সে প্রিয় স্বদেশভূমি বাংলাদেশে পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধবের সাথে একটি আনন্দপূর্ন সময় কাটাচ্ছিল।
অবিন্তা কবির এর ছিল প্রিয় বাংলাদেশে ও দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। সেই ছোটবেলা থেকেই তার মাঝে মানুষের অসহায়ত্বে সহমর্মিতা প্রকাশের নিদর্শন প্রকাশ পায়, যা ব্যক্তিজীবনে তাকে মানুষের সেবায় কাজ করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করে।
তার লেখনীর বহু অংশজুড়েই- নিজ দেশের অসহায় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে তার দায়িত্ববোধের কথা আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। তার ভাবনায় বিশেষ স্থান ছিল, আমাদের সমাজের অপেক্ষাকৃত বেশী সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সূচনালগ্নে ফ্রেশমেন সেমিনারে অবিন্তা লিখেছিলো, “I believe that it is my responsibility as a Bangladeshi to help those in need”।
তার লেখায় আরো উঠে আসে, “I aim to help those around me and give back to the people of my country who are suffering from poverty and hunger.”
অবিন্তার সুন্দর স্বপ্নগুলোর বাস্তবায়নে তার মায়ের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন’- একটি সামাজিক সংস্থা যা এই দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ও সমাজের কল্যাণে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে।
ফাউন্ডেশনের মূল লক্ষ্য – অবিন্তার জীবদ্দশায় তার পরিকল্পনাকৃত প্রতিটি ইচ্ছার স্বার্থক বাস্তবায়ন। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে প্রতিষ্ঠার পর থেকে – শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে অবিন্তার মূল্যবোধ ও আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন এগিয়ে যাচ্ছে তার লক্ষ্য পূরণে।
অবিন্তা তার স্কুলজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি আপন মূল্যবোধ থেকে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজে লিপ্ত ছিলেন। ২০১৭ সাল থেকে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন এসিডে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের পাশে দাড়াতে এসিড সার্ভাইভার্স ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রেশার গার্মেন্টস প্রদান করে আসছে। অবিন্তা সবসময় ‘হ্যাবিট্যাট ফর হিউম্যানিটি’ সংস্থার গরিব ও অসহায় মানুষদের জন্যে গৃহনির্মানের কার্যক্রমে একজন স্বেচ্ছাসেবী
হিসেবে কাজ করতেন। সেই অনুপ্রেরণা থেকে, অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ‘হ্যাবিট্যাট ফর হিউম্যানিটি’র মাধ্যমে গাজিপুর জেলার কালীগঞ্জে সুবিধাবঞ্চিত ১২ টি পরিবারকে গৃহনির্মান করে হস্তান্তর করা হয়।
অবিন্তার বিশ্বাস ছিল যে একটি পরিবারকে উন্নীত করতে হলে, সেই পরিবারের মা ও শিশুদেরকে সমানভাবে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। এই দেশের সুবিধাবঞ্চিত মেয়েশিশুদের সুশিক্ষার জন্যে অবিন্তা একটি স্কুল করতে চেয়েছিল- যেখানে সুবিধাবঞ্চিত মেয়েশিশুরা বিনামূল্যে সর্বাধুনিক শিক্ষা পাবে। আগামী ৫ জুলাই অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন স্কুলের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পূরণ হতে যাচ্ছে। স্কুলটি বর্তমানে ৮০ টি সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে আধুনিক উপায়ে শিক্ষা প্রদান করছে তাদের পরিপূর্ন ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়াসে।
নিজ দেশের শিল্প-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি ছিল অবিন্তার গভীর অনুরাগ। তার এই দেশপ্রেম ও আপন সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার মূল্যবোধ জাগ্রত হয় বিশেষত তার মা ও পরিবার থেকে।
অবিন্তার এই মূল্যবোধকে স্মরণীয় করে রাখতে- তার নানি পূর্বের ‘এথেনা গ্যালারী’ নামান্তরিত করে ‘অবিন্তা গ্যালারী অফ ফাইন আর্টস’ স্থাপন করেন। গ্যালারীটি অবিন্তার দেশপ্রেমের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে এই দেশের তরুণ ও উদীয়মান শিল্পীদের প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে।
অবিন্তা মনে করত যে, তাদের প্রজন্ম আজ বর্তমান- তারাই হবে আগামীদিনের পরিবর্তনের বাহক। তার নিজের ভাষায়, “I am the generation that is supposed to help the nation grow; I have to try my best to do what I can for my community”। অবিন্তার মহৎ এই ভাবনা অনুসরণ করে, এই বছর অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন এই দেশের যুব ও তরুণদের উন্নয়নে “Abinta’s Young Change Leaders” নামে একটি প্রোজেক্ট শুরু করেছে। এই প্রোজেক্টের মূল লক্ষ্য, এই দেশের তরুণ উদ্যেক্তাদের সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ প্রদান। কার্যত প্রোজেক্টির মাধ্যমে, অংশগ্রহণকারীদের হ্যাকাথন প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে ৬ মাসের জন্যে কর্ম-সহায়ক সুবিধা প্রদান করা হবে।
সময়ের স্রোতে জীবনধারায় পরিবর্তন আসে। আমরাও চাই সময়ের বিবর্তনে আমাদের প্রিয় ফাউন্ডার অবিন্তা কবিরের জীবনের আদর্শ ও মহত্ত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে সবার জন্যে সমান ও সুন্দর একটি বসবাসযোগ্য পৃথিবীর নিদর্শন ফুটিয়ে তুলতে।
অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের পথচলার প্রতিটি ধাপেই রয়েছে অবিন্তার জীবন আদর্শ- যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পরিবর্তনের নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত করে যাবে পৃথিবীজুড়ে।
-মুনতাসির আহসান
অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন
আরো পড়ুন,রাজবাড়ীতে জনপ্রতিনিধিকে মারপিট করেছে উপসহকারী প্রকৌশলী