গত দুই বছর ধরে চলমান করোনার তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্থ কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লী র উৎপাদন ও ব্যবসা বানিজ্য অনেক লড়াই সংগ্রাম করে, গেল কয়েকমাস ধরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। কারখানাগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে আগামী ঈদের সিজনের জন্য পোশাক উৎপাদনে দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছে ।
উৎপাদন স্বাভাবিক হলেও বেচাকেনা স্বাভাবিক না হওয়ায় বেশ উ˜ি¦গ্ন ও চিন্তিত গার্মেন্টস পল্লীর ব্যবসায়ীরা। তাদের উদ্বেগ আর চিন্তার কারন আরো বেশি জোড়ালো করেছে করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন।
কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীতে শোরুম রয়েছে প্রায় ১০ হাজার, কারখানাও রয়েছে ছয় হাজারের কাছাকাছি। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করে প্রায় ৮ লাখ শ্রমিক। সারা দেশ থেকে ক্রেতারা এসে পোষাক কিনে নিয়ে যায় এখান থেকে।
এখানকার ব্যবসায়ীদের দাবি দেশের তৈরি পোশাকের ৬০ ভাগ চাহিদা মেটায় কেরানীগঞ্জের এই গার্মেন্টস পল্লী। এখানে ব্যবসায়ীদের মধ্য ৭০ ভাগ নিজেরা পোশাক উৎপাদন ও বিক্রি করে, বাকি ৩০ ভাগ ব্যবসায়ী চীন,ভারত, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পোশাক এনে বিক্রি করে বলে জানা যায়।
কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লীর ব্যবসায়ীরা পোষাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ অথবা এফবিসিসিআই এর সদস্য না হওয়ার কারনে সহজ শর্তে ব্যাংক লোন কিংবা সরকারি প্রোনদনা কিছুই মিলে না তাদের। যার কারনে ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে চড়া
একাধিক ব্যবসায়ীর সাথে কথা হলে দেশ রূপান্তরকে তারা জানান, গত দুইবছরে করোনার ধাক্কায় দিশেহারা তারা। করোনা তাদের পূজি কেরে নিয়েছে। পুজি হারিয়ে ব্যবসায়ীরা অনেক সাহস করে সর্বোচ্চ ঝুকি নিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে চলতি বছরে আবারো তারা বিভিন্ন উপায়ে ব্যবসায়ে মূলধন বিনিয়োগ করেছেন।
গত কয়েকমাস ধরে কারখানাগুলোতে ঠিকঠাক মতোই চলছে উৎপাদন কাজ। তবে করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন শংকার কারন হয়ে দাড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানিয়েছেন, আগামী মার্চ-এপ্রিলে করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দেশে বড় ধরনের সংক্রমণ ঘটাতে পারে। তখন আবারো যদি লক ডাউন বা কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয় এ নিয়ে ভারি দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কারন তখন ব্যবসায়ীদের রোজার সিজন ।
সাধারণত রোযার ঈদের মৌসুমকে কেন্দ্র করেই গার্মেন্টস পল্লীর সারা বছরের ব্যবসা হয়। অন্যান্য সময় বেচাকেনা তেমন একটা হয় না । ব্যবসায়ীরা গত দুই বছর লসের ধাক্কা কাটিয়ে চলতি বছর আবারো ঘুড়ে দাড়াবেন এই আশাতেই ধার দেনা করে সারা বছর কারখানা চালিয়ে এসেছেন।
আগামী ঈদ সিজনে যদি ওমিক্রনের কারনে সব কিছু আবার নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় এবং বেচাকেনার পরিস্থিতি যদি আবার খারাপ হয়ে যায় তাহলে কিভাবে কি করবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
চায়না,থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে পোশাক আমদানি করে বিক্রি করেন আলম মার্কেটে মেসার্স মমতা এন্টারপ্রাইসের সত্তাধিকারী জামাল উদ্দিন মাহমুদ। এই ব্যবসায়ী জানান, করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা দেশের বাইরে যেতে পারছি না পন্য আনার জন্য। মোবাইলে পন্য আমদানির অর্ডার দিতে হচ্ছে। করোনার কারনে পন্যের দাম, ট্যাক্স প্রসেসিং সব বেড়ে গেছে। গত দুই বছরে যে লস হয়েছে তা হয়তো কাভার করা সম্ভব নয়।
কিন্তু গত কয়েক মাসে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে আমরা এই বছর ঘুড়ে দেখার স্বপ্ন দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম শীতে ও ঈদে ব্যবসা করে ধারদেনা কিছুটা কমাতে পারবো। কিন্তু বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাবে এই বছর শীত তেমন একটা পরেনি। যার কারনে শীতের বেচাকেনা আশানুরুপ হয় নি।
এখন ঈদকে সামনে রেখে আমরা দোকান সাজাচ্ছি, ঈদের জন্য মাল আমদানি করছি। কিন্তু করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন আবারো আমাদের কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে দিয়েছে। ঈদের আগে যদি আবার কঠোর বিধি নিষেধ দেয়া হয়, অথবা লক ডাউন দেয়া হয়, তাহলে বেচা কেনা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন ব্যবসা করে টিকে থাকাই আমাদের জন্য মুশকিল হয়ে পড়বে।
ভাই ভাই গার্মেন্টস কারখানার মালিক মো: আমির হোসেন জানান, আমি বিভিন্ন কোম্পানীর শার্ট মজুরিতে আমার কারখানায় সেলাই করি। সোরুম মালিকেরা সারা বছর শার্ট সেলাই করে আমাদের কারখানায় প্রতি মাসে কিছু খরচ দেয় বাকি পুরো টাকাটা রমজান মাসে পরিশোধ করে। গত দুইবছরে তেমন কাজ করতে পারি নি।
যতটুকুই করেছি সেই পাওনাই এখোনো সোরুম মালিকেরা করতে পারে নি। কারন তারা গত দুই রমজানে তেমন বেচাকেনা করতে পারে নি। এই বছর অনেক আশা নিয়ে সারাটা বছর কারখানা চালিয়েছি সিজনের বাকি মাত্র দুইমাস । এই সময়ে করোনা যদি আবার সমস্যার সৃষ্টি করে, বেচাকেনাও বন্ধ হয়ে যাবে সোরুম থেকে আমাদের পাওনা আদায় ও বন্ধ হয়ে যাবে। আমি কিভাবে আমার ধার দেনা শোধ করবো, আমার আন্ডারে প্রায় ২০ জন শ্রমিক কাজ করে ওদের সারা বছরের বেতন কিভাবে দিবো কিছুই ভাবতে পারছি না। আমার মতো এমন বহু কারখানা রয়েছে যারা মজুরিতে কাজ করে তাদের কি অবস্থা হবে ?
কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ শেখ কাওসার জানান, দুই বছরের করোনার ধাক্কায় অন্যান্য ব্যবসায়ের ন্যায় গার্মেন্টস পল্লীর ব্যবসা বানিজ্যও স্থবির হয়ে পড়েছে। এখানকার ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন সেক্টর থেকে ধার দেনা করে চলতি বছর আবারো ঘুড়ে দাড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন আবারো দুশ্চিন্তার কারন হয়ে দাড়িয়েছে আমাদের জন্য। ইতিমধ্যে এখানকার অনেক ব্যবসায়ী লসের ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন। সামনে সিজনের সময় যদি আবারো লক ডাউন কিংবা কঠোর বিধি নিষেধ দেয়া হয় আর বেচা কেনা না হয় তাহলে যারা বাকি আছে তাদের ও ব্যবসা বানিজ্য গুটিয়ে নেয়া ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। সকলের উচিত করোনার স্বাস্থ্যবিধি ঠিকমতো মেনে চলা।
কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক মুসলিম ঢালীর সাথে কথা হলে দেশ রূপান্তরকে তিনি জানান,এখন পর্যন্ত করোনায় ব্যবসা বানিজ্যে আমরা যে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি তা অপূরনীয়, তবে এটাকে কাটিয়ে উঠা সম্ভব। এমনটি আমরা চলতি বছরে তা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছিলাম। তবে শুনেছি মার্চ এপ্রিলে ওমিক্রন বড়ো ধরনের আঘাত হানতে পারে, এ জন্য আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
দুই বছর ব্যবসা না করার পরে ভেবেছিলাম এই বছর স্বাভাবিক ভাবে ব্যবসা বানিজ্য করবো। কিন্তু ওমিক্রনের কারনে তা আর হচ্ছে না হয়তো। অনেক ব্যবসায়ীরা ঈদ মৌসুমকে সামনে রেখে বড়ো প্রস্তুতি নেয়ার চিন্তা করেছিলো তবে ওমিক্রনের কারনে এখন তারা চিন্তা ভাবনা বদলে ছোট পরিসরে ব্যবসা করার চিন্তা করছে। এইবছর সিজনের সময় যদি ওমিক্রন ধাক্কা দেয়, তাহলে ব্যবসায়ীদের পথে বসা ছাড়া আর কোন রাস্তা থাকবে না। ব্যবসায়ীরা ঘুড়ে দাড়াতে পারবে না, এই এলাকার ব্যবসাও ধ্বংশের মুখে চলে যাবে।।