কেরানীগঞ্জ; ঢাকা জেলার বুকে একটি আদর্শ নগরী
কেরানীগঞ্জ,
ঢাকা জেলার ৫টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে কাছের উপজেলা।
বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর তীর ঘেষে গড়ে ওঠা কেরানীগঞ্জ, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে একটু একটু করে পরিবর্তীত হচ্ছে। শ্যামল সবুজ প্রকৃতি, বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন, সবকিছুর সহজলভ্যতা আর মনমুগ্ধকর পরিবেশের সমন্বয়ে কেরানীগঞ্জ উপজেলা নিজেকে গড়ে তুলেছে জীবনধারণের জন্য একটি আদর্শ শহররূপে।
কেরানীগঞ্জ এর নামকরণ ও এর ইতিহাসঃ
১৬৭ বর্গ কিলোমিটারের কেরানীগঞ্জ এর নামকরন নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ।
একপক্ষের মতবাদ থেকে জানা যায়,
এক সময় বাংলায় আফগান কররান বংশের শাসন ছিলো। ১৫৭৪ সালের দিকে মুগল সম্রাট আকবর যখন বাংলা আক্রমন করেন। তখন কররাননা আকবরের আক্রমনে দিশেহারা হয়ে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে দক্ষিন তীরে কিছুদিন আশ্রয় গ্রহন করে। কোররানীদের এই কিছুকাল অবস্থানের কারনেই সম্ববত কেরানীগঞ্জ নামের উৎপত্তি। নামটি হওয়ার কথা ছিলো কররানগঞ্জ। কিন্তু তৎকালীন সময়ে নামের বিকৃতি উচ্চারন করা একটি মতলবী ফ্যাশন ছিলো। তাই কররানগঞ্জ না উচ্চারন করে কেরানীগঞ্জ উচ্চারন করা হতো। এভাবেই কেরানীগঞ্জ নাম প্রচারিত হতে থাকে।
আরেকটি মতবাদ থেকে জানা যায়,
নবাব শায়েস্তা খানের আমলে নবাবের কেরানীরা বুড়িগঙ্গা নদীর এপারে থাকতেন সেই থেকেই নাম হয়েছে কেরানীগঞ্জ।
অপর একটি মতবাদ অনুসারে,
মুঘল আমলে ঢাকার তৃতীয় গভর্নর ইব্রাহীম খানের দুইজন কেরানী বুড়িগঙ্গার এইপারে বসবাস করতেন সেখান থেকেই কেরানীগঞ্জ এর নাম করন করা হয়েছে।
নামকরন যেভাবেই হোক না কেন দিন দিন কেরানীগঞ্জ দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবেই গড়ে উঠছে। এছাড়া ঐতিহাসিক দিক থেকেও জায়গাটির গুরুত্ব অসীম। ১৭৫৭ সালে শাসক পরিবর্তনের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী এবং তার এক খালা ঘষেটি বেগম কারাবন্দী ছিলেন এই কেরানীগঞ্জ এর জিঞ্জিরাতে ।
মুক্তিযুদ্ধে কেরানীগঞ্জ এর ভূমিকাঃ
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কেরানীগঞ্জ গুরুত্বপূর্ন ভ’মিকা পালন করে। কেরানীগঞ্জ থেকেই মোস্তফা মহসীন মন্টুর নেতৃত্বে পাকিস্তানী বাহিনীর উপর বিভিন্ন জায়গায় গেরিলা হামলা চালানো হয়। ঢাকা কেন্দ্রীক পাকিস্তানী বাহিনীর উপর যে হামলাগুলো চালানো হয় তা কেরানীগঞ্জ থেকেই পরিকল্পনা করা হয়।
কেরানীগঞ্জ এর ভৌগলিক ও প্রশাসনিক কাঠামোঃ
১৯৮৩ সালে সর্বপ্রথম কেরানীগঞ্জ থানা থেকে উপজেলায় রূপ নেয়। সর্বপ্রথম উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন ফরহাদুর রহমান। ১৯৮৩ থেকে ২০২০ এ পর্যন্ত কেরানীগঞ্জ এ ২২ জন উপজেলা নির্বাহী অফিসার কেরানীগঞ্জ এর উন্নয়নে কাজ করেছেন।
কেরানীগঞ্জ এর উত্তরে রয়েছে মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ,কামরাঙ্গীচর, লালবাগ ও কোতওয়ালী ও সুত্রাপুর থানা এবং সাভার উপজেলা অবস্থিত। পূর্বে শ্যামপুর থানা ও নারায়নগঞ্জ সদর উপজেলা। দক্ষিনে সিরাজদিখান উপজেলা এবং পশ্চিমে নবাবগঞ্জ উপজেলা অবস্থিত।
কেরানীগঞ্জ ঢাকা ২ এর কিছু অংশ ও ঢাকা ৩ সম্পূর্ন সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত। পুলিশ প্রসাশনের ভিত্তিতে কেরানীগঞ্জ এখন দু’টি থানায় বিভক্ত যথাঃ কেরানীগঞ্জ মডেল থানা ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা
কেরানীগঞ্জ এ মোট কয়টি ইউনিয়ন?
ঢাকা-৩ আসনে ৫ টি এবং ঢাকা-২ আসনে ৭ টি, মোট ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে কেরানীগঞ্জ উপজেলা গঠিত। ইউনিয়নগুলি হচ্ছে,
ঢাকা ৩ আসনঃ
১। জিনজিরা
২। আগানগর
৩। শুভাঢ্যা
৪। তেঘরিয়া
৫। কোন্ডা।
ঢাকা ২ আসনঃ
১। হযরতপুর
২। কলাতিয়া
৩। তারানগর
৪। শাক্তা
৫। বাস্তা
৬। কালিন্দী
৭। রুহিতপুর
মোট ১২টি ইউনিয়নে ১২৫ টি মৌজায় ৪২৭ টি গ্রাম রয়েছে কেরানীগঞ্জ এ।
শিল্পখাতে কেরানীগঞ্জ এর অবদানঃ
পোষাক শিল্পঃ
দক্ষিন এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো তৈরী পোষাকের মার্কেট কেরানীগঞ্জ এর কালিগঞ্জে অবস্থিত। দেশের ৭০ ভাগ পোষাকের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানী করা হয় এখানকার পোষাক।
জিনজিরার রয়েছে অনেক বড়ো বড়ো কারখানা, যেখানে যে কোন যন্ত্রাংশ একবার দেখলে তারা হুবুহু তার কপি বানিয়ে দিতে পারবে সাশ্রয়ী মূল্যে। মেড ইন জিনজিরা এখন আর অভিষাপ নয়, কেরানীগঞ্জ এর জন্য আশির্বাদ।
জাহাজ শিল্পঃ
জাহাজ শিল্পের জন্যেও কেরানীগঞ্জ এর খ্যাতি রয়েছে। কেরানীগঞ্জ এর শুভাঢ্যায় গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম জাহাজ নির্মান ও ডক ইয়ার্ড শিল্প। দেশের অনেক নামিদামী কোম্পানী তাদের জাহাজ বানিয়ে নিয়ে যায় কেরানীগঞ্জ থেকে।
কৃষিঃ
কেরানীগঞ্জ এ মোট কৃষি জমির পরিমান ১১৪২০ হেক্টর। এর মধ্যে তিন ফসলী জমি ৫৯১০ হেক্টর ও দুই ফসলী জমি ৩৪০৪ হেক্টর। তবে দিন দিন কমে যাচ্ছে কেরানীগঞ্জ এর কৃষি জমির পরিমান। হাউজিং কোম্পানী গুলোর প্রভাবে দিন দিন কমে যাচ্ছে কেরানীগঞ্জ এর কৃষি জমি। আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়কার সুজলা সফলা শষ্য শ্যামলা কেরানীগঞ্জ। তবে আশার কথা হচ্ছে যতটুকুই কৃষি জমি আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে কেরানীগঞ্জ এর মানুষ। বিশেষ করে সবজি উৎপাদনে কেরানীগঞ্জ অনেক এগিয়ে।
রাজধানী ঢাকার কাছাকাছি হওয়ায় এবং মান ভালো হওয়ায় কেরানীগঞ্জ এর সবজির কদর রয়েছে ঢাকার কারওয়ান বাজারসহ অন্যান্য পাইকারী বাজারগুলোর আড়ৎদারদের নিকট। রাত শেষ হয়ে ভোরের সূর্য ওঠার সাথে সাথেই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের পাইকারী সবজি ক্রেতারা ভীড় জমায় কলাতিয়া,হযরতপুর,তারানগরের বিভিন্ন পাইকারী সবজি বাজারে। শুধু তাই নয় কেরানীগঞ্জ এর সবজি সরাসরি বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও রপ্তানী করা হয়।
কেরানীগঞ্জ এর জনসংখ্যা কত?
কেরানীগঞ্জে জনসংখ্যা কাগজে কলমে ৮ লাখের মতো থাকলেও কেরানীগঞ্জ এ প্রায় ১৫ লাখের উপরে লোকের বসবাস। দিন দিন কেরানীগঞ্জ যত উন্নত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কেরানীগঞ্জ এ কাজের উদ্দেশ্য আশা লোকজনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কেরনীগঞ্জ এ বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রঃ
আধুনিক কেরানীগঞ্জ এ দিন দিন বিনোদন কেন্দ্রের সংখ্যা বেড়েই চলছে। সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ হবার কারনে কফিশপ,রিসোর্ট,ফুডকোডের সংখ্যা দিন দিন কেরানীগঞ্জ এ বেড়েই চলেছে। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন থিম এবং এমিউজমেন্ট পার্ক। ছুটির দিনগুলোতে এসব বিনোদন কেন্দ্রে কেরানীগঞ্জ এর আশে পাশের এলাকা থেকেও লোক আসে ঘুড়ার জন্য।
সম্প্রতি শুভাঢ্যা খালকে কেন্দ্র করে রাজধানীর হাতির ঝিলের মতো একটি বিনোদেন কেন্দ্র নির্মানের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার । এতে খরচ হবে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা।
রাজউকের উদ্দ্যাগেও কেরানীগঞ্জ এ ঘাটারচরে ১৫৫ কোটি টাকা ব্যায়ে শেখ রাসেল ওয়াটার পার্ক নামে একটি বিনোদন কেন্দ্র নির্মানের পরিকল্পনাও হাতে নেয়া হয়েছে। এতে করে কেরানীগঞ্জ আরো আধুনিক হবে। কেরানীগঞ্জ এর মানুষদেরও বিনোদনের জন্য নদী পার হয়ে রাজধানী ঢাকায় যেতে হবে না ।
শিক্ষাঙ্গণ ও ক্রীড়াঃ
শিক্ষা ও ক্রীড়াঙ্গনে কেরানীগঞ্জ এর সাম্প্রতিক সময়ের সফলতা চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশ এর কিংবদন্তি ক্রিকেটার মোহাম্মদ রফিক এই কেরানীগঞ্জ এর ই গর্ব। এছাড়া খেলাধুলার পাশাপাশি শিক্ষার হার কেরানীগঞ্জ এ দিন দিন বেড়েই চলেছে। খেলাধূলায় কেরানীগঞ্জ এর ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও এগিয়ে যাচ্ছে সমান তালে। নারী ক্রিকেটের নতুন শক্তি এখন কেরানীগঞ্জ।
এছাড়াও কেরানীগঞ্জ এ গড়ে উঠেছে নিত্য নতুন আধুনিক সব শপিং কমপ্লেক্স। ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার স্থাপন করা হয়েছে কেরানীগঞ্জ এর আবদুল্লাহপুর এলাকায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মান করা হচ্ছে কেরানীগঞ্জ এ। পদ্মা সেতুর সাথে ঢাকাসহ সারা দেশের সংযোগ স্থাপন করতে কেরানীগঞ্জ এর উপর নির্মিত ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেস হাইওয়ে কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নপূরণের স্বাক্ষী। তাই যোগাযোগের এ পথটিকে কেন্দ্র করে কেরানীগঞ্জ এর উন্নয়ন বেড়ে গেছে আরো বেশী মাত্রায়।
একসময় বাত্তির নিচে অন্ধকার থাকা কেরানীগঞ্জ এখন ঢাকা সহ সারাদেশে আলো ছড়িয়ে দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ঢাকাসহ সমগ্র দেশের বুকে হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ন এবং সমৃদ্ধ স্থান। ইতোমধ্যেই বসবাসের জন্যে একটি আদর্শ জায়গা হিসেবে কেরানীগঞ্জ কে বেছে নিয়ে অনেকেই ঝুকছেন কেরানীগঞ্জ এর দিকে। অদূর ভবিষ্যতে রাজধানীবাসির জন্য কেরাণীগঞ্জ স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে বলে কেরানীগঞ্জ এবং এর আশেপাশে বসবসাকারী সকল নাগরিকের বিশ্বাস।
রাজু আহমেদ
নিউজ ঢাকা ২৪