এই সিঙ্গা লাগাই……, দাঁতের পোক ফালাই…। খা…খা…খা…… বখখিলারে খা…! কাঁচা ধইরা খা…!” এই হাক ডাক গুলো আজ আর শোনা যায় না। আধুনিকায়নের এই যুগে- আগের মত এখন আর বেদে সম্প্রদায়ের লোকদের চোখে পরে না। কালের গহ্বরে যেনো হারিয়ে যেতে বসেছে।
চিরচেনা গ্রামীণ জনপদের এই সম্প্রদায় গুলো। বিজ্ঞানের চরম উন্নতিতে গ্রাম কিংবা শহর সব স্থানেই এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। টিভি, কম্পিউটার আর সেল ফোনেই যেনো বিনোদনের প্রধান মাধ্যমে পহয়েছে। বেদের হাক-ডাক বানর আর সাপ খেলায় মানুষ এখন আর আকৃষ্ট হয় না। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে চিন্তার ও বিনোদনের ও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আধুনিকতার এই যুগে কেমন আছেন ঠিকানা বিহীন জীবনে এই যাযাবর বেদে ও মানতা সম্প্রদায়রা। নিজ ভূখন্ডে বাস করেও পরবাসী যেন এরা।
নৌকার বহর নিয়ে নৌ-পথে চলাচল করে এ সম্প্রদায়। এখন নৌ-পথে বাধ, বড় নদী থেকে খালে সব জায়গায় নদীর গতিপথ বাধা পরে যাওয়ার ফলে নৌকা নিয়ে চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ছোট বড় নদী নব্যতা হারানোর ফলেও প্রধান বাধা হয়ে উঠেছে তাদের চলা চলের। নদী ও হাওর দিনে দিনে শুকিয়ে যাওয়ায় বেদেরা এখন সড়ক পথে উঠে এসেছে। হাট-বাজারের ও পরিত্যক্ত স্থানে ছোট-ছোট ঝুপড়ি-খুপরি ঘর তুলে বসবাস করেছে। বেদেনীরা সাপ খেলা, বানর খেলা,ঝার ফোক,যাদুটুনা দেখায় এবং তাবিজ-কবজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় গাঁয়ের পথে প্রান্তরে । তবে আগের মত সারা না পাওয়ায় আশাহত হয়ে পরছেন এই সম্প্রদায়ের মানুষ গুলো।
খুব বেশি একটা সারা না পাওয়ায় সাপ ধরার নেশা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাদের হাজার বছরের বংশ পরম্পরায় পেশা বাদ দিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে হচ্ছে তাদের । গুটিকয়েক যারা এ পেশাকে আগলে রেখেছে তাদের জীবন চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এদের রাজ্য নেই আছে জলে ভাসা নৌকার বহর এই বহরই এদের রাজ্য। এই বহরের প্রধান হলো সরদার আর এই সরদারই হল রাজা। এই রাজাই নিয়ন্ত্রণ করেন বেদের এই বহরকে। সবাই এই বহরকে রাজ্য সম সম্মানে রাখেন। জলে ভাসা জিবনেও তাদের আছে বেস জোড়ালো নিয়ম কানুন তা মেনেই সবাইকে চলতে হয়। বেদে সম্প্রদায়ের সর্দার এদের রাজা। তার নিয়ন্ত্রনে চলতে হয় বহরের সবাইকে। সর্দাররা বংশক্রমেই সরদার হয়। সর্দারের পরিবারের বড় ছেলেই পরবর্তী সর্দার বা রাজা হয়ে থাকেন। সর্দারের দৃষ্টিতে অপরাধ করলে বেদে সমাজে জুতা পেটা, অর্থ দন্ডসহ নানা ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। এই সম্প্রদায়ের মেয়েরাই প্রধানত আয় রোজগার করে। পুরুষরা সারাদিন বাচ্চাদের দেখাশুনা ও ঘরের কাজ করে থাকে। কেউ কেউ পুকুর-ডোবায়, তলিয়ে যাওয়া সোনা, রুপা তুলে দেয়ার কাজ করে। এবং বিভিন্ন রোগের ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজ সহ বিক্রি করছে শাড়ী, চুড়িসহ প্রসাধনীও। কেউ কেউ ভানুমতি খেলা ও জাদুমন্ত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে মানুষের দুয়ারে ।
বেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে অনেক উপ-সম্প্রদায়। যেমন, মীশ্চিয়ারি, গাড়লীমালবৈদ্য, বাজিকর, হাতলেহেঙ্গা,শালদার, বান্দরওয়ালা, কুড়িন্দা, সওদাগার। বেদেদের ব্যবসার মৌসুম শেষ হলে বেদে পরিবারে বিয়ের আয়োজন করা হয়। বিয়েতেই তারা সবচেয়ে আনন্দ করে থাকে। বেদের বিয়েতেও আছে বেশ ভিন্নতা। পূর্ব নির্ধারিত করা গাছের মগ ডালে অথবা ঘরের চালে বসে বর তার পর নেয় মৃত্যু ঝুকি। কনে গাছের নিচে এসে বরকে নামানোর জন্য কাকতি-মিনতি করে। কনে বরকে আজীবন আয়-রোজগার করে খাওয়াবে বলে একের পর এক প্রতিশ্রম্নতি ও প্রলোভন দেয়। তখন বর গাছ বা চাল থেকে নেমে আসে। আর এভাবেই বিয়ে সম্পূর্ণ হয়।
এদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে নেই কোন ধারনা। তাই প্রত্যেকের গড়ে ৭-৮টি সন্তান রয়েছে। অন্য, বস্র শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান কোন ধরনের মৌলিক চাহিদার সুযোগ সুবিধা তারা পায় না। সাহায্য-সহায়তায় নেই সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগ। এরা সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। দেশ, সমাজ,সভ্যতার অনেক কিছুই জানা নেই তাদের।
অর্থনীতি, রাজনীতির খবরও নেই তাদের কাছে। ভোটের রাজনীতি, ভোটাধিকার, কে জিতল আর কে হারলো সে খবর তারা রাখে না এরা। ভূখন্ডের শত শত বছরের পুরনো বাসিন্দা হলেও এদের নেই কোন প্রকার নাগরিক অধিকার। কঁচুড়িপানার মতোই নদীর পানিতে ভেঁসে বেড়ায়। নাগরিক পরিচয় সংকট এ সম্প্রদায়ের নাম সাক্ষর করতে পারে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় এবং ভূমি সমস্যায় এ সম্প্রদায়ের মানুষের মানবেতর জীবন যাপনে করে থাকে।
এ সম্প্রদায়ের কারো মৃত্যু হলে কলা গাছের ভেলায় লাশ ভাসিয়ে দেয়া হতো। আর বর্তমানে এর পরিবর্তন এনে নদীর পাড়ে বা কোন ভূস্বামীর দানকৃত পরিত্যাক্ত ভূমিতে ঠাঁই মিলে যাযাবর লাশটির। তার পর আবারও নৌকা নিয়ে ছুটে চলা। নদীর মাঝে ঢেউয়ের বুক চিরে। অজানা অনিশ্চিত ও দুর্বিষহ জিবনের দিকে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট খোরশেদ মাহমুদ
Fabulous, what a blog it is! This web site presents valuable facts to us,
keep it up. adreamoftrains best web hosting company