শবে বরাত হচ্ছে বছরের একটি ফজীলতপূর্ণ রাত । এ রাতেই নিহিত রয়েছে মুমিন-মুসলিমের মুক্তি ও কল্যাণের বিভিন্ন উপকরণ। তাই শবে বরাতের রাতকে বলা হয়েছে মুক্তির রাত। অন্যদিকে পবিত্র মাহে রমজানের পূর্বের মাস হওয়ার কারণে শাবান মাসকে বলা হয়েছে রমজান শরীফের প্রস্তুতির মাস।
লাইলাতুল বরাত অনেক তাৎপর্য, ফযীলত ও বরকত রয়েছে। মহানবী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) এরশাদ করেনঃ
শাবান মাস হল আমার মাস আর পবিত্র রমজান মাস হল মহান আল্লাহ তাআলার মাস।
তিনি আরও বলেন, তোমরা শাবানের চাঁদ সঠিকভাবে হিসাব রাখ।
কেননা শাবানের চাঁদের হিসাব ঠিক হলে, রমজানের চাঁদের হিসাব সঠিক হতে সহায়ক হবে। ( মিশকাত শরীফ-১১৫পৃ )
শা’বান মাসের ১৪তম তারিখের দিবাগত রাত হচ্ছে- লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত।
লাইলাতুল বরাত হচ্ছে-গুনাহ থেকে মুক্তি লাভের রাত্রি।
অর্থাৎ, এ রাত্রে ইবাদত-বন্দেগী করার মাধ্যমে মুমিন-মুসলামনদের গুনাহ মাফ হয়ে থাকে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি হয়ে থেকে।
শা’বান এবং শবে বরাত করণীয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) এরশাদ করেন,
শাবান মাসের রোযা আমার নিকট অন্য মাসের তুলনায় অধিক প্রিয়।
যখন তোমাদের নিকট শাবানের রাত্রি ( শবে বরাত) উপস্থিত হবে, তখন তোমরা সেই রাতটি জাগ্রত থাক ( নামাজ পড়ে, কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করে,
তাসবীহ পড়ে, যিকির করে, দুআ করে ) এবং দিনের বেলা রোযা রাখ।
কারণ, এ রাতে মহান আল্লাহ সূর্যাস্তের পর থেকে ফজর পর্যন্ত দুনিয়ার আসমানে তাশরীফ আনেন
এবং তিনি ঘোষণা করেন- আছে কি এমন কোন ব্যক্তি যে, তার গুনাহ মাফীর জন্য আমার নিকট প্রার্থনা করবে? আমি তার গুনাহ সমূহ মাফ করে দিব।
আছে কি এমন কোন রিযিক প্রার্থনাকারী, যে আমার নিকট রিযিক প্রার্থনা করবে? আমি তার রিযিকের ব্যবস্থা করে দিব।
আছে কি এমন কোন বিপদগ্রস্ত, যে আমার নিকট বিপদ থেকে মুক্তি চাইবে? আমি তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করব।
এভাবে পূর্ণ রাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা হতে থাকে এবং বান্দাদের উপর রহমত বৃষ্টির ন্যায় নাজিল হতে থাকে।
এ বিষটি মনে রাখতে হবে, এ রাতের আমলসমূহ বিশুদ্ধ মতানুসারে সম্মিলিত নয়; নির্জনে একাকীভাবে করণীয়।
পুরুষদের জন্য তো ফরয নামাজ অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে।
তারপর তারা এবং মহিলারা যা কিছু নফল পয়রার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বেন।
এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোন প্রমাণ হাদীসে নেই।
আর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। (ইকতিযাউস সিরাতুল মুস্তাকিম,২য় খন্ড-৬৩১পৃ, মারাকিল ফালাহ-২১৯পৃ )
তবে কোন ঘোষণা ও আহবান ছাড়া এমনিতেই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যান, তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবেন। একে অন্যের আমলে ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হওয়া যাবে না।
শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসিমানী ( দামাম বারকাতুম ) বলেন, ইমাম আযম আবু হানীফা ( রহমতুল্লাহি আলাইহি ) বলেছেন, নফল ইবাদত এমনভাবে করবে যে, সেখানে কেবল তুমি আছ, আর আছেন আল্লাহ। তৃতীয় কেউ নেই।
সুতরাং, যে কোন নফল ইবাদতের ক্ষেত্রেই শরীয়তের অন্যতম মূলনীতি হল, তাতে জামাআত করা মাকরুহে তাহরীমী ও নিষিদ্ধ। ( ইসলাহী খুতুবাত, ৪র্থ খণ্ড-২৬৮পৃ )
হযরত আশরাফ আলী থানভী ( রহমতুল্লাহি আলাইহি )-এর মতঃ
তিনি বলেন হাদীসে শবে বরাতের তিনটি কাজ সুন্নত মত করাকে সওয়াব ও বরকত লাভের উপায় বলা হয়েছে। প্রথমতঃ পনেরো তারিখ রাতে কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করা। সাথে সাথে গরীব মিসকীনদের কিছু দান করে সে দানের সওয়াবটুকু ঐ মৃতদের নামে বখশে দিলে আরও ভাল হয়। সেই মুহূর্তে হাতে না থাকলে, অন্য সময় গোপনে কিছু দান করে দেওয়া উচিত। দ্বিতীয়তঃ রাত জেগে একা একা বা বিনা আমন্ত্রণে জড়ো হয়ে যাওয়া দু চারজনের সাথে ইবাদতে মশগুল থাকা। তৃতীয়তঃ শাবানের পনেরো তারিখ নফল রোযা রাখা।
শবে বরাতে আমাদের সমাজঃ
সমাজের একশ্রেণির লোক ইসলামের দেওয়া সুস্থ-সুন্দর পদ্ধতির বিপরীতে নিজেদের কুরুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার আবিষ্কার করে থাকে।
মহিমান্বিত এ রাতে যেখানে গুনাহ মাফ চাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে, সেখানে বিভিন্ন গুনাহে লিপ্ত হতে দেখা যায় এ শ্রেণির লোকদে
শবে বরাত পালন বলতে আতশবাজি করা, হালুয়া-রুটির আয়োজন করা, বিশেষ পদ্ধতির নামায পড়াকে জরুরী মনে করা,
এ রাতে গোসল করা ফযীলতপূর্ণ মনে করা, এ রাতে মসজিদে গিয়েই ইবাদত করাটা বাধ্যতামূলক মনে করা, ইত্যাদী বিদআত।
শরীয়ত গর্হিত আক্বিদা ও কাজ। এসব করা জায়েজ নয়।
এ পর্যায় শবে বরাতের নামে সমাজে প্রচলিত কিছু শরীয়তবিরোধী আমলের চিত্র তুলে ধরা হলো যেন আমরা নিজেরা এগুলো থেকে বিরত থাকি এবং সমাজটাকেও এ সকল ইবাদতের নামে পাপাচার থেকে মুক্ত রাখতে পারি।
শবে বরাতে আতশবাজি করা শরীয়ত সম্মত নয়। আর এটা দ্বীন ইসলামের কোন শেয়ারের অন্তর্ভুক্ত নয়।
প্রকৃতপক্ষে আতশবাজি হিন্দু ধর্মের একটি ধর্মীয় প্রথার অন্তর্ভুক্ত।
তাই মুসলমানের জন্য এসব করা সম্পূর্ণ রূপে হারাম ও নাজায়েয।
কারণ হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেন, মহা নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল বা সাদৃশ্য রাখবে তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে।” (আহমদ, আবূ দাউদ)
হালুয়া রুটি কুসংস্কারঃ-
আরেকটি কুসংস্কার হল হালুয়া রুটির। কিছু কিছু মুসলমানের কাছে প্রথাটি এতই জরুরি যে তাদের ধারণা হালুয়া-মিষ্টির আয়োজন ছাড়া শবে বরাত ই হয় না। এটাও শয়তানের এক প্রকার সূক্ষ্ম কারসাজি।
হালুয়া-মিষ্টি রুটির চক্করে ফেলে দিয়ে মুসলমানদের ইবাদত করা থেকে দূরে রাখাই তার উদ্দেশ্য।কিন্তু শবে বরাত হল ইবাদতের রাত্রি,একটি মুহুর্ত নষ্ট না করে সারা রাত বন্দেগী করার রাত্রি। এর সাথে হালূয়া রুটির কি সম্বন্ধ?
হালুয়া, রুটি, মোরগ পোলাও বা ভোজ আয়োজনের জন্য শবে বরাত নয়।
শবে বরাত তো রাত জেগে ইবাদত করা ও গুনাহগার বান্দা আল্লাহ তায়ালার রহমতের শামিয়ানায় আশ্রয় নিয়ে মাগফিরাত লাভ করে নিজেকে সৌভাগ্যমন্ডিত করে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই মহান আল্লাহ শবেবরাত দান করেছেন।
ওলীদের ও বুজুর্গানদের শবে বারাতঃ
পূর্বে উল্লেখিত দলীলসমূহের আলোকে অধিকাংশ সলফে সালেহীন তথা ওলী বুজুর্গানে দ্বীন শবে বরাতের তাৎপর্য ও ফজীলতের পক্ষে ছিলেন। তাঁরা রাতটিকে খুবই সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ মনে করতেন।
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন, যেন রাতটি ইবাদতে কাটে এবং তার মাহাত্ন্য ও ফজীলত অর্জন করা যায়।
কিন্তু যেমনিভাবে সলফে সালেহীন তো এই রাতে জাগরণ থেকে ইবাদত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন,
তেমনিভাবে এ রাতকে কেন্দ্র করে সংঘটিত যাবতীয় কুসংস্কার ও বিদআত থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
কেননা, আহলে-হক রসূল প্রেমিক সকল মুসলমানের ঈমানী কর্তব্য হলো,
যে আমল শরীয়তে যতটুকু প্রমাণিত সেই আমলটিকে ঠিক ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ রাখা।
এর মধ্যে অতিরঞ্জিত করা, নিজ খুশিমত কোন আমল সংযোজন করা পরিস্কার বিদআত বলে গণ্য-যা দ্বীনের জন্য বড় সর্বনাশ ও পথভ্রষ্টতার মূল কারণ।