সম্পত্তি ভাগের বিষয় এবং একাধিক বিয়ের দ্বন্দ্বে রাজধানীর কাকরাইলে মা-ছেলের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। নিহত শামসুন্নাহারের স্বামী আবদুল করিমের একাধিক বাড়ি থাকলেও তৃতীয় স্ত্রী শারমিন মুক্তা থাকতেন ভাড়া বাসায়। নিহতের স্বজনেরা জানিয়েছেন সর্বশেষ তিনদিন আগেও স্বামীর মালিকানাধীন বাড়িতে ওঠার তৎপরতা চালিয়েছিলেন মুক্তা। প্রতিবেশীদের দাবি এর আগে তিন দফায় একই চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি।
১ নভেম্বর বুধবার রাতে কাকরাইল রাজমণি সিনেমা হলের পাশে তমা কনস্ট্রাকশন ভবনের পশ্চিমের গলির ৭৯/১ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলায় খুন হন মা শামসুন্নাহার (৪৮) ও তার ১৭ বছর বয়সী ‘ও’ লেভেল পড়ুয়া ছেলে শাওন।নিহত শামসুন্নাহারের অন্য দুই ছেলে অনিক (২২) ও মুন্না (২০) বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন ব্যারিস্টারে পড়ার জন্য ।
ওই বাড়ির দারোয়ানকে বুধবার সন্ধ্যায় পাচ তলায় ‘গোলমাল হচ্ছে’ জানিয়ে এক যুবক বেরিয়ে যায়। তার যাওয়ার পর উপরে গিয়ে মা এবং ছেলের লাশ দেখতে পান। সেসময় রান্নাঘরের দরজা খুলে গৃহকর্মী রাশিদা বের করেন দারোয়ান নোমান । পরে করিম কে ফোন দেয়া হলে তিনি শ্যামবাজারের নিজের আড়ত থেকে ফেরেন।
আড়ৎের ব্যবসার পাশাপাশি পলওয়েল মার্কেটে বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে করিমের এমনটাই জানিয়েছে পুলিশ। চলচ্চিত্র প্রযোজনার অফিস বানিয়ে রাজমণি সিনেমা হলের পাশে একটি ভবনেই বসতেন করিম। এফডিসির কয়েকটি ছবিতে অর্থের ও যোগান দিয়েছেন বলে যানা যায়। এছাড়া কাকরাইল ও নয়াপল্টন এলাকায় তার ৩টি বাড়ি রয়েছে।
পুলিশ এখন পর্যন্ত করিমের তিন স্ত্রীর কথা জানতে পেরেছে। তবে ২য় বউর সাথে তালাক হয় তার। শারমিন মুক্তার সঙ্গে ২০১৩ সালে চলচ্চিত্র প্রযোজনার সুবাধে পরিচয়ে ২০১৫ সালে বিয়ে করেন তারা। বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া দ্বিতীয় স্ত্রীর খোঁজ করছেন তারা।
করিমের বাসার ভাড়াটিয়া জাকির জানান মূলত তৃতীয় বিয়ে করার পর থেকে করিমের সংসারে অশান্তি শুরু হয়। তৃতীয় বউ মুক্তা দুই বছরে তিন বার প্রথম বউকে মারধর করেছে।
শামসুন্নাহারের ছোট ভাই আশরাফ জানা
আশরাফ জানান, ভাড়া বাসা ছেড়ে কাকরাইলের বাসায় ওঠার জন্য অনেকবার চেষ্টা চালিয়েছেন মুক্তা। আর তাতে বাধা দেওয়ার কারণে শামসুন্নাহারের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ তিনদিন আগে বাসায় ঢুকে শামসুন্নাহারকে বেধড়ক মেরে বাসার জিনিসপত্র ভেঙ্গে চলে আসেন মুক্তা।
এই ঘটনা ফোনে আশরাফকে জানিয়ে মৃত্যুর শঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন শামসুন্নাহার। আশরাফ থানায় জিডি করার পরামর্শ দিলেও তা আর করেননি শামসুন্নাহার।
আব্দুল করিমের বাসার ভাড়াটিয়া ও প্রতিবেশী জাকির হোসেন জানান, করিমের তৃতীয় স্ত্রী মুক্তাকে বিয়ে করার পর থেকেই অশান্তি শুরু হয়। মুক্তা দুই বছরে তিনবার প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহারের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে মারধর করেছেন। এসব হামলায় মুক্তার সঙ্গে তার আপন ভাইকেও দেখা গেছে।
আশরাফের দাবি একাধিক বিয়ে ছাড়াও বিবাহবহির্ভূত সর্ম্পকেও জড়িয়ে ছিলেন করিম। আর তাতে বাধা দিতো শামসুন্নাহার। তার আশঙ্কা, এসব কারণেই তৃতীয় স্ত্রী মুক্তা ও করিম পরিকল্পনা করে লোক দিয়ে হত্যা করেছে শামসুন্নাহার ও তার ছেলেকে।
আবদুল করিমের পরিবার, প্রতিবেশি ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০ থেকে ২৫ বছর আগে আব্দুল করিম ছিলেন শ্যামবাজারে মাথায় করে সবজি বিক্রি করতেন। এছাড়া গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজের বাইরে থেকে আলু কুড়িয়ে তা রাজধানীতে বিক্রি করতেন। এরপর হঠাৎ করেই শ্যামবাজারে পেয়াজ ও আদার আড়তের ব্যবসা শুরু করেন। রাজধানীতে তিনটি বাড়ি, আড়ত দোকান ছাড়াও রাঙ্গামাটিতে ১৫০ বিঘা, গাজীপুরে ৫০ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন আব্দুল করিম। এসব জমি বিভিন্ন সময়ে দখল করা হয়েছে। এসব কারণে তার নামে বিভিন্ন থানায় ৫০ টিরও বেশি মামলা রয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে শামসুন্নাহার ও তার ছেলের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ জানিয়েছেন, মায়ের বুকের ওপরে একটি ছুরির আঘাত ছিলো, যা ফুসফুসে আঘাত হেনেছে। আর ছেলের বুকের দুইপাশেই ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। দু’টি আঘাতই ফুসফুস ভেদ করে গেছে। এরকম একটি আঘাতে যে কারও মৃত্যু হতে পারে।
এ ঘটনায় নিহতের ভাই আশরাফ আলী বাদী হয়ে চারজনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করেছেন।
রমনা থানার ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম বলেন, তৃতীয় স্ত্রীকে ঘিরেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা করছি। পারিবারিক কলহ, তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম স্ত্রীর বনিবনা না হওয়া ও শামসুন্নাহারের ওপর কয়েকবার হামলাসহ নানা বিষয়কে কেন্দ্র করেই তদন্ত চলছে।