
অ্যাডভোকেট সুব্রত বর্মন জানান তার মেয়ে ফার্মগেট এ হলিক্রস স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। নিহতের পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা যায় যে, ওয়াইডব্লিউসিএ হাইয়ার সেকেন্ডারি গালর্স স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সম্মিলিত মেধা তালিকায় সবসময় প্রথম স্থানে থাকা মেয়েটি মেধার দিক থেকে ছিলো দুরন্ত। তবে হঠাত করেই তার এ মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। মৃত্যুর আগে স্বর্ণা একটি সুসাইড নোট রেখে যায় যেটা দেখে প্রথম সন্দেহ করা হয় যে ব্লু হোয়েল এর শিকার ছিলো সে।

‘ব্লু হোয়েল’ গেমটি সাধারণত সাধারণ কোন সার্চ ইঞ্জিন বা এপ স্টোরে পাওয়া যাবে না। গোপন কোন লিংকের মাধ্যমে যদি কেউ গেমটি শেয়ার করে তবেই এটি পাওয়া সম্ভব। তবে ডার্ব গেমটি প্রথম ছড়ায় মূলত ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে। এটি একটি সুইসাইড গেইম অর্থাৎ গেমটি খেলতে থাকলে গেমারের মৃত্যু অনিবার্য । অনেকে কিশোর কিশোরী কৌতুহল থেকেই গেম টি খেলা শুরু করে,ভাবে যে সঠিক সময়ে বেরইয়ে আসবে। কিন্তু সেটি আর শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে ওঠে না।
অনেকে মনে করেন যে, নীল তিমিরা সাধারণ জীবনের এক পর্যায়ে সাগরতীরে এসে আত্মহত্যা করে ! আর এ ধারণা থেকেই মরণফাঁদ এর নাম রাখা হয়েছে ‘ Blue whale ‘ বা নীল তিমি । সাধারণত গেমটি ইন্সটল করার পর গেমকে কিউরেটর দ্বারা সবগুলো স্তর খেলতে বাধ্য করা হয়। গেমটিতে রয়েছে ৫০ টি ধাপ যার শেষ ধাপ অর্থাৎ ৫০ মত লেভেলে গেমার কে আত্মহত্যা করতে হয় । আর আত্মহত্যার মাধ্যমেই গেমের নিয়ম অনুযায়ী সে বিজয়ী হয়।

F57 নামক রাশিয়ান হ্যাকার টিম গেমটি তৈরি করে । যদিও গেমটি তৈরি হয়েছিলো ২০১৩ তে , তবে ২০১৫ সালে VK. com নামক সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে গেমটি ছড়িয়ে পড়ে। নিজ ভার্সিটি থেকে বহিষ্কৃত হওয়া সাইকোলজির ছাত্র এবং রুশ হ্যাকার ফিলিপ বুদেকিন ই এই গেমটির জন্ম দেয়। পরে রাশিয়ান আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা গ্রেফতার হয় সে। গ্রেফতারের পর সে জানায় যে হতাশা গ্রস্থদের পৃথিবীত বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই আর তাই তাদেরকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্যই গেমটি বানিয়েছে সে।

এ গেম খেলে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা নেহাত কম নয়। রাশিয়ায় ১৫১ জন , এবং রাশিয়ার বাইরে প্রায় ৫০ জন এ পর্যন্ত এ গেমের শিকার হয়ে মারা গেছেন । এই গেইমের প্রথম শিকার জুলিয়া ওভা ও ভের্নিকা ওভা নামক দুই বোন । গেমটির ৫০ তম লেভেল এর চ্যালেঞ্জ পূরণ করতে গিয়ে বড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে সুইসাইড করেছিলো এ দুই বোন। মৃত্যুর ঠিক আগে সোশাল নেটওয়ার্কে নীল তিমির ছবি আপলোড দিয়ে – ‘ The end ! ‘ লিখে বিদায় নিয়েছিলো ।
গেমটি আপনি একবার ইন্সটল করার পর এটি ফোনের সিস্টেমে ঢুকে ফোনের আই পি এড্রেস , মেইলের পাসওয়ার্ড , ফেসবুক পাসওয়ার্ড , কনট্যাক্ট লিস্ট , গ্যালারী ফটো এমনকি \ব্যাংক ইনফর্মেশান ও সংগ্রহ করতে থাকে ! গেমটি ওপেন করা মাত্র আপনাকে একজন এডমিন বা কিউরেটর গেমার কে পরিচালনা শুরু করে । গেমটির প্রথম দশটা লেভেলে এডমিন সাধারণত কিছু তুলনামূলক সহজ নির্দেশনা দেন – যেমন গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে হরর মুভি দেখা , চিল্লাচিল্লি করা , উঁচু ছাদের কিনারায় হাঁটাহাঁটি করা , পছন্দের খাবার খাওয়া ইত্যাদি । প্রথম দশ টা লেভেল পার করার পর গেমারকে তৈরি করা হয় পরবর্তী দশটি লেভেলের জন্য । প্রায় লেভেল পনেরো লেভেল পর্যন্ত চলে ইনফরমেশান হাতানোর কাজ ! পনেরো লেভেলের পর শুরু হয় কঠিন মিশন। যেমন অ্যাডমিন ভিক্টিম কে নিজ হাতে ব্লেড দিয়ে নীল তিমির ছবি আঁকতে বলে।
প্রথম বিশটি চ্যালেন্জ অতিক্রম করার পর অ্যাডমিন শুরু করে তার কৌশল পরিবর্তন করতে । প্রথম বিশ ধাপে সংগ্রহ করে ফেলা তথ্যের উপর ভিত্তি করে ভিক্টিম কে মোহাক্রান্ত বা হিপনোসিস পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু করা হয় । গেমার কে তখন মানসিকভাবে এ গেমের প্রতি আসক্ত করে ফেলা হয়। শীতের দিনে খালি গায়ে ঘুরে বেড়ানো , বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করা , বন্ধুর মোবাইল চুরি করা , সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর দুর্ব্যবহার করা এ ধরণের মিশন দেয়া হয় গেমারকে। এসব মিশন শেষ করে প্রমাণের ছবি বা ফটো পাঠাতে হয় এডমিনকে। এভাবে কৌশলে বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের থেকে কৌশলে আলাদা করে ফেলা হয় গেমারকে আর এভাবে সে পৌছে যায় লেভেল পঁচিশ এ। এর পর থেকে খেলোয়াড়ের প্রতি নির্দেশনা আসবে মাদক বা ড্রাগ নেবার। আর এভাবেই সম্মোহিত করে করে গেমারকে তিরিশ লেভেল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় ।
একত্রিশতম লেভেল থেকে ভিক্টিমের আপনার নগ্ন ছবি , ভালোবাসার মানুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে তার গোপন ছবি , নিজের শরীরে একাধারে শ খানেক সুঁই ফুটিয়ে তার ছবি ইত্যাদি চাওয়া হয় । সাধারণত গেমের শেষদিকে এসে ভিক্টিম ভীত হয়ে গেমটি খেলা বন্ধ করে দিতে চায় কিন্তু ব্ল্যাকমেইলিং বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার পথে। গেমার টিম বা এডমিন তখন ভিক্টিমের পঠানো সকল তথ্য ফাঁস করে দেবার হুমকি দিয়ে, গেমারকে গেম খেলতে বাধ্য করে এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
ইদনিংকালে কৌতুহল থেকে অনেক বাংলাদেশী বাচ্চারা এ গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সের কিশোর কিশোরীরা। নিতান্ত কৌতুহল থেকে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত গেমটি বেধে রাখছে এসব কিশোর কিশোরীকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যদি কার্যকরী ব্যাবস্থা না নেয়া হয় তবে হয়তো এ মৃত্যুফাঁদে পা দিয়ে শেষ হয়ে যাবে আরো অনেকগুলো কচি প্রাণ।
ব্লু হোয়েল গেমটিতে ব্যাবহৃত থিম মিউজিক।