৬ দফাই বাঙালির মুক্তির আলোকবর্তিকা

বাঙালির জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ঐতিহাসিক ৬ দফা ছিল দেশ ও জনগণের জন্য মুক্তির সনদ।৭ জুন ১৯৬৬। বাংলাদেশের ইতিহাসের খাতার একটি পাতা। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের এক অগ্নিঝরা দিন এই ৭ জুন। আত্মত্যাগে ভাস্বর এই দিন বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের সূচনা হয়।

৬ দফা গুলো হলো—

প্রথম দফা : সরকারের বৈশিষ্ট্য হবে Federal বা যৌথরাষ্ট্রীয় ও সংসদীয় পদ্ধতির; তাতে যৌথরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন হবে প্রত্যক্ষ এবং সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার প্রতিনিধি নির্বাচন জনসংখ্যারভিত্তিতে হবে।

দ্বিতীয় দফা : কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব থাকবে কেবল প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় এবং তৃতীয় দফায় ব্যবস্থিত শর্তসাপেক্ষ বিষয়।

তৃতীয় দফা : পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক মুদ্রা-ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা পারস্পরিকভাবে কিংবা অবাধে উভয় অঞ্চলে বিনিময় করা চলবে। অথবা এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে একটি মুদ্রা-ব্যবস্থা চালু থাকতে পারে এই শর্তে যে, একটি কেন্দ্রীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার অধীনে দুই অঞ্চলে দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। তাতে এমন বিধান থাকতে হবে যেন এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সম্পদ হস্তান্তর কিংবা মূলধন পাচার হতে না পারে।

চতুর্থ দফা : রাজস্ব ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে। প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় রাজস্বের যোগান দেয়া হবে। সংবিধানে নির্দেশিত বিধানের বলে রাজস্বের এই নির্ধারিত অংশ স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে জমা হয়ে যাবে। এহেন সাংবিধানিক বিধানে এমন নিশ্চয়তা থাকবে যে, কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্বের প্রয়োজন মেটানোর ব্যাপারটি এমন একটি লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে যেন রাজস্বনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নিশ্চিতভাবে অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে থাকে।

পঞ্চম দফা : যৌথরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্য যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে, সেই অঙ্গরাজ্যের সরকার যাতে স্বীয় নিয়ণ্ত্রনাধীনে তার পৃথক হিসাব রাখতে পারে, সংবিধানে সেরূপ বিধান থাকতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হবে, সংবিধান নির্দেশিত বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত অনুপাতের ভিত্তিতে অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে তা আদায় করা হবে। সংবিধান নির্দেশিত বিধানানুযায়ী দেশের বৈদেশিক নীতির কাঠামোর মধ্যে, যার দায়িত্ব থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক সরকারগুলোর হাতে থাকবে।

ষষ্ঠ দফা : ফলপ্রসূভাবে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কাজে সাহায্যের জন্য অঙ্গরাজ্যগুলোকে মিলিশিয়া বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে।

৬ দফার এসব দাবির আলোকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপরেখা রচিত হয়। আর এ রূপরেখার মহান নায়ক বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ তার নেতৃত্বে ৬দফার প্রতি বাঙালির অকুণ্ঠ সমর্থনে রচিত হয় স্বাধীনতা। বলা হয় ৬দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অঙ্কুরিত হয় স্বাধীনতার বীজ। ৬ দফা ভিত্তিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে চূড়ান্ত রূপ নেয়। কেননা, ১৯৬৬ সালের ৬দফার পর ১৯৬৯ সালে ১১দফা আন্দোলনের পথপরিক্রমায় শুরু হয়। যার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে ৬ দফার মধ্যদিয়ে।

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বাংলার জনগণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনোনীত প্রার্থীদের সমর্থন করে জনগণ প্রমাণ করে ৬ দফার যোক্তিকতা। কিন্তু দুখের বিষয়- অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর দলকে জনগণ বিজয়ী করলেও স্বৈরাচারী পাক শাসক গোষ্টি বিজয়ী দলকে সরকার গঠন করতে দেয়নি। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন শুরু করেন।

আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১-এর ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ৬দফার প্রতিটি দফার পর্যালোচনা ছিল বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণে। যার উপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

বাস্তবতা হলো অনেক আগেই স্বাধীন বাংলাদেশের ভাবনাটি বঙ্গবন্ধুর মাথায় ছিল। যার নির্দেশনা পাওয়া যায় ছয় দফায়। তাই ৬ দফার মধ্যদিয়ে প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা এসেছে। এ কারণে ৬ দফাকে বলা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের একটা মাইল ফলক। জন্ম হয়েছিল স্বাধীন ও সার্বোভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ৭ই জুন এক অবিস্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন।

লেখক: ইব্রাহিম হোসাইন সানিম

সহ-সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে [sharethis-inline-buttons]

Check Also

বাহারছড়া ইউপির চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকন শিকদারের খোলা চিঠি!

ডেস্ক: প্রিয় টেকনাফ বাহারছড়া ইউনিয়নবাসী আসসালামু আলাইকুম। মহান আল্লাহর রহমতে আশা করি আপনারা ভাল আছেন। …

error: Content is protected !!