নিজস্ব প্রতিবেদক: রহিমা খাতুন, জন্ম ১৯৫৫ সালের পহেলা নভেম্বর যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানায়। পিতার বদলীজনিত কারনে পড়াশোনা করেছেন যশোর জেলার বিভিন্ন স্কুলে। ১৯৮২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন তিনি। ১৯৮১ সালে তিনি আসেন ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলায়।
তিনি যখন সদরপুর আসেন নারী শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল সদরপুর। তখন সদরপুরে ছিল মাত্র ৩ টি স্কুল, আমিরাবাদ ফজলুল হক পাইলট ইনস্টিটিউশন, বাইশরশি শিব সুন্দরী একাডেমী এবং বাবুরচর উচ্চ বিদ্যালয়।
বাইশরশি শিব সুন্দরী একাডেমী এবং বাবুরচর উচ্চ বিদ্যালয় ছিল সদরপুর থেকে বেশ দূরে যেখানে সদরপুরের মেয়েরা যেয়ে পড়াশোনা করতে পারতো না। আর আমিরাবাদ ফজলুল হক পাইলট ইনস্টিটিউন যা ছিল খরস্রোতা নদী ভুবনেশ্বর নদের ওপারে যেখানে যেতে হত বাশের সাঁকো পাড়ি দিয়ে যা ছিল মেয়েদের জন্য দুরূহ ব্যাপার। তখন নারীশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে ১৯৮১ সালে রহিমা খাতুন ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ৫ জন, ৭ম শ্রেণিতে ২ জন এবং ৮ম শ্রেণিতে ১ জন, মোট ৮ জন ছাত্রী নিয়ে শুরু করেন তার স্কুলের পাঠদান কার্যক্রম।
স্কুলের নাম দেন বেগম কাজী জেবুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। তখন থেকেই তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের অভিভাবকদের বোঝাতে শুরু করেন নারী শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে। এর জন্য তাকে অনেক কটু কথার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমনকি তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও শুনতে হয়েছে অনেক বাজে মন্তব্য। কারন তৎকালীন সময়ে নারীশিক্ষাকে অনেক বাঁকা চোখে দেখা হতো। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন নি।
যখন বাড়িতে কোনো মেয়ের পুরুষ অভিভাবক না থাকতেন তখন লুকিয়ে লুকিয়ে যেতেন সেই মেয়ের মা বা বোনের কাছে, বুঝিয়ে বলতেন নারী শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে। তার একান্ত ব্যক্তিগত অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯৮১ সালের পর ১৯৮২ সালে তার ই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় ১৭ জন ছাত্রী।
১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন নারীশিক্ষার প্রসারে। যতই বাধা আসুক হাল ছাড়েন নি তিনি। এরপর থেকে তার স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা বাড়তেই থাকে এবং ২০১৫ সালে ৮ জন ছাত্রী নিয়ে শুরু করা স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা দাড়ায় ১৪০০ তে। তিনি যে শুধুু ছাত্রীদের পড়াশোনাই করাতেন তা নয়।
তিনি তার স্কুলের ছাত্রীদের কে পড়াশোনার পাশাপাশি মেয়েদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা করাতেন। তিনি নিজে সাথে করে ছাত্রীদের নিয়ে যেতেন জেলা শহর ফরিদপুরে ছাত্রীদের খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করাতে। তিনি নিজে উপজেলা শিল্পকলা একাডেমীর একজন সদস্য হয়ে ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন। বেগম কাজী জেবুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়কে সরকারিকরণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনি। একটি বেসরকারি বিদ্যালয়কে সরকারিকরণে যা যা করতে হয় সব নিজে করেছেন।
২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে তিনি বেগম কাজী জেবুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয় হতে প্রধান শিক্ষিকা পদ থেকে (ছাত্রীদের কাছে যিনি ছিলেন ভালোবাসার বড় আপা) অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি যে পরিশ্রম করে গিয়েছিলেন, তিনি যেই কাজটি এগিয়ে রেখেছিলেন, সেই পরিশ্রমের, সেই কাজের ফলস্বরূপ ২০১৬ সালে স্কুলটি সরকারিকরণ হয়। নাম হয় বেগম কাজী জেবুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
তিনি যে শুধু একটি বালিকা বিদ্যালয়ের ই প্রতিষ্ঠাতা এখানেই শেষ নয়। ১৯৮৭ সালে সদরপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয় সদরপুর মহিলা কলেজ এবং তিনিই ছিলেন সেই সদরপুর মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। সদরপুরের নারীশিক্ষাকে সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে যেতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন এই মহিয়সী নারী।
তার নারীশিক্ষা বিস্তারের এক সহযোগী বা সহোযোদ্ধা ছিলেন বাবু রমেন্দ্রলাল ভৌমিক। বেগম রোকেয়া যেমন নারী শিক্ষার বিস্তারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন সেই বেগম রোকেয়ার আদলে রহিমা খাতুনকে বাবু রমেন্দ্রলাল ভৌমিক বলতেন “সদরপুরের বেগম রোকেয়া”।
রহিমা খাতুন বলেন,যখন তিনি আমাকে সদরপুরের বেগম রোকেয়া বলেছিলেন বা ওনার দেখাদেখি অনেকেই আমাকে সদরপুরের বেগম রোকেয়া বলতেন, আমি ভাবতাম আমাকে সবাই ব্যঙ্গ করছে। আমাকে সবাই তাচ্ছিল্য করছে। কিন্তু আমি যখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নারীশিক্ষা ক্ষেত্রে স্বীকৃতি স্বরূপ ‘বেগম রোকেয়া পদক ২০২২’ এর জন্য মনোনয়ন পাই তখন বুঝেছিলাম বাবু রমেন্দ্রলাল ভৌমিকের আমাকে দেওয়া নাম সদরপুরের বেগম রোকেয়া এটা একেবারেই কোনো ব্যঙ্গ বা তাচ্ছিল্য ছিল না।