পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর থেকে উদ্বোধন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। বিশেষত বিশ্ব ব্যাংকের কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সেই সময় অনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে কল্পিত দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ আনে ।
তবে বিশ্বব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে কানাডার আদালতে তাদের দূর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করে রাষ্ট্রের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইস্পাত কঠিন মনোবল ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে আত্মবিশ্বাসী করেছে এবং বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, পদ্মা সেতু ও এ সংশ্লিষ্ট সব অবকাঠামো নির্মাণে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। পুরো প্রকল্পের ব্যয় এই অংকের হলেও মূল সেতু নির্মাণে এর তিন ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ১২ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অথচ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা আর বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন আরো বেশি ৫০ হাজার কোটি টাকা। সবার জানা উচিৎ অনেক টাকা খরচ হয়েছে নদীশাসন, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, সার্ভিস এরিয়া, গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন , বৃক্ষরোপণ, পদ্মা সেতু জাদুঘর, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পসহ অন্যান্য খাতে।
বিস্তারিত খরচের খাতের হিসাব এবার জানা যাক-
ভায়াডাক্টসহ মূল পদ্মা সেতুতে খরচ- বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে – ভায়াডাক্টসহ পদ্মা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৯.৩০ কি.মি.। এর মধ্যে জলভাগ পদ্মা নদীতে ৬.১৫ কি.মি, স্থলভাগে অর্থাৎ মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে পড়েছে মোট ৩.১৫ কি.মি.।সেতুর পাশ দিয়ে ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ লাইনের জন্য খরচ ১ হাজার কোটি এবং রেললাইনের পাশ দিয়ে গ্যাস লাইন নির্মাণে খরচ হচ্ছে আরও ৩০০ কোটি টাকা।প্রকল্পে মূল সেতু নির্মাণে প্রকৃত খরচ হচ্ছে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা।
নদী শাসনে খরচ- পদ্মা সেতুতে প্রায় ১৪ কি.মি নদী শাসনের জন্য চীনের কোম্পানি সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডকে দিতে হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে খরচ- বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে – পদ্মা সেতুর দুই পাশের সাথে সংযোগ সড়ক মোট ১২.৩২ কি.মি এবং ১৫ কি.মি সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে মোট ব্যয় হয় ১ হাজার ৯০৭ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকা।
জমি অধিগ্রহণে খরচ- পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় অধিগ্রহণকৃত ২ হাজার ৬৯৩ দশমিক ২১ হেক্টর জমির জন্য ব্যয় হয় প্রায় দুই হাজার ৬৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ।
পুনর্বাসনে খরচ- পদ্মা সেতু নির্মাণে সাতটি পুনর্বাসন সাইট নির্মাণ এলাকায় তিন জেলার ২২ হাজার ৫৯৩ জন ক্ষতিগ্রস্তদের আবাসিক প্লট বরাদ্দ বাবদ ও ভিটা উন্নয়নে এ পর্যন্ত প্রায় ৭৮৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা খরচ হয় ।
ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট কনসালটেন্সি খাতে ব্যয় সর্বমোট ৬৭৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
পরিবেশ খাতে ব্যয়-পদ্মা সেতু এলাকায় জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি খাতে এ পর্যন্ত সর্বমোট ব্যয় ১২৯ কোটি ৩ লক্ষ টাকা।
অন্যান্য খাতে খরচ- ৪ হাজার কর্মকর্তা – কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, যোগাযোগে খরচ , ভ্যাট – ট্যাক্স, পদ্মা সেতুর জাদুঘর নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ, গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ অন্যান্য খরচ যেমন মসজিদ, বিদ্যালয়, কবরস্থান,পদ্মা সেতু প্রকল্পের পুনুর্বাসন এলাকায় চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৩টি নতুন মসজিদ নির্মাণ, তিনটি কবরস্থান নির্মাণ ও তিনটি মসজিদও সংস্কার, যশোলদিয়া ও কুমারভোগ এলাকার জলবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে আউট-লেট ড্রেন নির্মাণ, ৪৮ টিউবওয়েল স্থাপনসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় ১ হাজার ৭৬৭ কোটি ১৭ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে।
পদ্মা সেতুর ২০০৭ সালের প্রাথমিক খরচ ১০ হাজার কোটি টাকা থেকে ৩০ হাজার কোটি কিভাবে হলো?
* ২০০৭ সালের প্রাথমিক পরিকল্পনায় সেতুটি ছিল একতলা। পরবর্তীতে সেতুর নকশা পরিবর্তন করে রেললাইন সংযুক্ত করে সেতুটিকে দোতলা করায় সেতুর খরচ বেড়ে যায় প্রায় দ্বিগুণ।
* ২০০৭ সালের পরিকল্পনায় সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ৫.৫৮ কি.মি. যা পরে বেড়ে দাঁড়ায় ৬.১৫ কি.মি । মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ০.৫৭ কি.মি বেড়ে যায়। কিন্তু ভায়াডাক্ট ৩.১৫ কি.মি. সহ পুরো সেতুর দৈর্ঘ্য হয় ৯.৩০ কি.মি । ফলে স্বাভাবিক কারণেই খরচ বেড়ে যায়।
* ২০০৭ সালের প্রাথমিক পরিকল্পনায় সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে ৩টি স্প্যান একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় রাখার ব্যবস্থা ছিল (Navigation) জাহাজ চলাচলের জন্য। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে খরস্রোতা পদ্মার কথা চিন্তা করে জাহাজ চলাচলের জয় ৪১টি স্প্যানেরই উচ্চতা বাড়ালে খরচ বেড়ে যায় অনেক বেশি।
* ২০০৭ সালের প্রাথমিক পরিকল্পনায় ভূমি অধিগ্রহণের আনুমানিক পরিকল্পনা ছিল ২ হাজার ৭৭৭ একর জমি, যা পরে বাস্তবে গিয়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৬৫৫ একর। অর্থাৎ আড়াইগুণ বেড়ে যায় এবং জনস্বার্থে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ক্ষতিপূরণের পরিমাণও তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
* ২০০৭ সালের প্রাথমিক পরিকল্পনায় ফেরিঘাট স্থানান্তরের ব্যয় ধরা ছিল না, যা পরে সংশোধিত বাজেটে ধরা হয়।
* ২০০৭ এর প্রাথমিক পরিকল্পনায় পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা দল নিয়োগ ও তাদের নৌযান সংগ্রহের বিষয়টি ছিল না, যা পরে সংশোধিত বাজেটে যুক্ত হওয়ায় খরচ বেড়ে যায়।
* ২০০৭ এ পদ্মা সেতুর ব্যয় যখন প্রথমে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, তখন ডলারের মূল্য ৬৮/৬৯ টাকার মতো ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে ব্যয় প্রাক্কলনের সময় ডলার প্রতি ব্যয় করতে হয়েছে ৮৪.৮০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডলার কিনতে প্রায় ২৪ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি ব্যয় করতে হয়েছে।
ফলে বিদেশি কনসালট্যান্টদের বেতন ও পদ্মা সেতুর তৈরির কাঁচামাল উর্ধগতির জন্য সঙ্গত কারণেই প্রাক্কলিত ব্যয়ের বেশি ব্যয় হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণে।
লেখকঃ ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক