মঞ্চস্থ হলো দৃষ্টি বগুড়া জেলা শাখার ব্যতিক্রমী আবৃত্তি প্রযোজনা ‘চুপ থেকো না মেয়ে’। নান্দনিক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে নারী জাগরণের কালজয়ী ইতিহাস মঞ্চে তুলে আনলেন সংগঠনের আবৃত্তি শিল্পীরা। শুদ্ধ সাবলীল উচ্চারণের মধ্য দিয়ে পাঠ করলেন মানুষের অধিকার আদায়ে নারী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও বিবর্তন।
প্রযোজনায় ব্যবহার করা হয়েছে বাঙালির চিরচেনা লোকজ ফর্ম ও আঞ্চলিক শব্দ। পান্ডুলিপির ভাষা, সুর ও তাল এবং উপস্থাপনার মুন্সিয়ানায় ছবির মতো মুর্ত হয়ে উঠেছে এই উপমহাদেশে নারী আন্দোলনের ঐতিহাসিক ঘটনা ও সময়।
প্রযোজনায় গাওয়া হয়েছে এমন কিছু গান, যা নারী জাগরণের অন্তর্নিহিত শক্তি হয়ে উঠেছে। লোকজ ধাচে গাওয়া এসব গানের সুর ও কথা সংগঠনের নিজের। নিজেরাই গেয়েছেন, বাজিয়েছেন ঢোল ও কর্তাল। গান, কথা, সুরের উপস্থাপনায় শ্রোতারা উদ্বেলিত হয়েছেন বাঙালি নারীর অদম্য সাহসে।
প্রযোজনা শেষে মঞ্চে অনুভুতি ব্যক্ত করতে আসা নাট্য ও সংস্কৃতীকর্মীরা অকপটে স্বীকার করলেন, বগুড়ায় আবৃত্তির এমন ব্যতিক্রমী প্রযোজনা এর আগে আর মঞ্চায়ন হতে দেখেননি তারা। এ ধরণের প্রযোজনা নারীর অধিকার আদায় ও নারী জাগরণে নারী-পুরুষ সম্মিলিত সংগ্রামের অনুপ্রেরণা ও সাহস জোগাবে।
গত শনিবার বগুড়া জেলা পরিষদ মিলনায়তনে এই প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়। প্রযোজনা শেষে সংক্ষিপ্ত উন্মুক্ত আলোচনায় প্রযোজনার নানা দিক নিয়ে কথা বলেন প্রযোজনার অধিকর্তা প্রতীক ইজাজ। পরে প্রযোজনার ওপর অনুভুতি ব্যক্ত করেন বগুড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহ সভাপতি এবিএম জিয়াউল হক বাবলা ও সহ সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির, নজরুল পরিষদ বগুড়ার সভাপতি এড. মনতেজার রহমান মন্টু, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ বগুড়ার সভাপতি শ্যামল বিশ্বাস, থিয়েটার আইডিয়ার পরিচালক নিভা রানী সরকার ও দৃষ্টি বগড়ুা জেলা শাখার সভাপতি মোস্তাক ইবনে মাহবুব শুভ।
প্রযোজনা শুরু হয় দর্শকসারী থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান ‘জাগো নারী জাগো বন্হিশিখা’ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। প্রযোজনা অধিকর্তা দর্শকসারীর সামনে এসে প্রযোজনা শুরু হওয়ার ঘোষণা দেন। সঙ্গে সঙ্গে দর্শক-শ্রোতা ও মুল মঞ্চের আলো নিবে যায়। জ্বলে ওঠে দর্শক-শ্রোতাদের সঙ্গে বসে থাকা শিল্পীদের হাতের প্রদীপ। এ সময় শিল্পীরা ঢোল ও কর্তাল বাজিয়ে সমস্বরে গাইতে থাকেন ‘জাগো নারী জাগো বন্হি শিখা’ গানটি। গাইতে গাইতে শিল্পীরা একে একে মঞ্চের সামনে প্রজ্বলিত প্রদীপ রেখে মুলমঞ্চে উঠে যান। এ সময় দর্শক-শ্রোতা সারীর আলো নিবে যায়। আলো-আধারীতে জ্বলে ওঠে মুলমঞ্চ। শুরু হয় প্রযোজনা।
৩৫ মিনিটের প্রযোজনায় নারী জাগরণের কালজয়ী ইতিহাস আবৃত্তি করেন শিল্পীরা। কখনো একক, কখনো দ্বৈত, কখনোবা সম্মেলক কন্ঠে উচ্চারিত হয় পান্ডুলিপি। সঙ্গে যুক্ত হয় ঢোল ও কর্তালের সুর। বিষয়ভিত্তিক লোকজফর্মের গান প্রযোজনাকে দেয় নতুন মাত্রা।
মঞ্চসজ্জাও ছিল নান্দনিক। গ্রামীন অবকাঠামোর ওপর নির্মিত মঞ্চকে মনে হয়েছে চিরচেনা আন্দোলনের পাদপীঠ। পেছনে বিশাল আকারের ‘চুপ থেকো না মেয়ে’ লেখা সম্বলিত ব্যাানার, মঞ্চের দু’পাশে বেড়ার ওপর লাল-নীল কাগজের টুকরা ও মঞ্চের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাছ ধরার পলো থেকে জ্বলে ওঠা আলো-আধারী মঞ্চকে রুপ দেয় শক্তির আধার হিসেবে।
সংগঠনের প্রচারপত্রে প্রযোজনা সম্পর্কে বলা হয়, ১০৭০-১০৭৫ খ্রিস্টাব্দে উত্তর বাংলার কৈবর্ত বিদ্রোহে জেলে-কৃষক বধূ থেকে শুরু করে ২০১৯ সালে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে মারা ফেনির মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতসহ জানা অজানা অসংখ্য নারী ভাত সম্ভ্রম মর্যাদা আদায়ে লড়েছে অদম্য সাহসে। ব্রিটিশবিরোধী ও তেভাগা আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষার লড়াই, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- সবখানে সর্বজনীন ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার বিপ্লবে নারীর অবদান কালজয়ী ইতিহাস। এই প্রযোজনা এই উপমহাদেশের সর্বশ্রেণির নারীদের জেগে ওঠার হাজার বছরের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস পাঠ; জীবন উৎসর্গের লাল সালাম।
‘চুপ থেকো না মেয়ে’- সংগঠনের ২৯তম প্রযোজনা। পান্ডুলিপি লিখেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রতীক ইজাজ। প্রযোজনার পরিকল্পনা ও ভাবনায় ছিলেন শ্রাবণী সুলতানা। প্রযোজনায় অংশ নেন সংগঠনের আবৃত্তি শিল্পী সাবেকুন নাহার মৃত্তিকা, ওমর ফারুক, মোস্তাকিম ইসলাম, আনহা তাসিন, সঞ্জয় কুমার জয়, আফসানা সিম্ফনী সিমী, মশিউর রহমান হ্যাপি, সাবিহা তাছরিন, কানিজ বারী তানমি, শ্রাবণী সুলতানা, রওশন আরা পারভীন সাথী, জাকারিয়া পারভেজ ও প্রতীক ইজাজ। মঞ্চ সজ্জায় ছিলেন মশিউর রহমান হ্যাপি ও সঞ্জয় কুমার জয়। আবহ সংগীত করেছেন জুলকার নাঈন ও ইরতেজা নুরেন তাহারাত। প্রযোজনার আমন্ত্রনপত্র ডিজাইন করেছেন তৌহিন হাসান।